বিষাদময় যাত্রা শেষে বিদায় নিচ্ছে ২০২০। অন্য যে কোনো বছরের চেয়ে আলাদা এ বছরের শেষ সূর্য ডুবছে আজ বিশ্বজুড়ে কভিড-১৯জনিত রোগে প্রায় সাড়ে সাত লাখ মানুষের না ফেরার দেশে চলে যাওয়ার গভীর বেদনা নিয়ে। দু’হাজার বিশ সালের পুরোটাই ছিল করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বিধ্বংসী এক বছর। সারা বিশ্বের মত বাংলাদেশকেও বিপর্যস্ত করেছে এই ভাইরাস।
একদিকে এই ভয়ংকর অতিমারির টিকা আবিস্কার ও তা প্রয়োগের গভীর স্বস্তি, অন্যদিকে ভাইরাসের নতুন ধরনের বিস্তারের শঙ্কা জমে আছে ২০২০-এর এই বিদায়ী সূর্যজুড়ে।সারাবিশ্বের আট কোটির বেশি মানুষের শরীরে এখনও এই মহামারির বিষ জমে আছে। এই বিষাক্ত হাওয়ার ভেতরেই শুরু হবে নতুন বছর ২০২১।
করোনা মহামারি
২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর চীনের উহান থেকে খবর এসেছিল, করোনাভাইরাসের নতুন একটি ধরন গ্রাস করতে আসছে পৃথিবীকে। তারপর যত দিন গেছে, সেই আতঙ্ক আরও প্রবল হয়েছে। মহামারি দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়েছে চীনের সীমানা পেরিয়ে ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা হয়ে এশিয়ার প্রায় সব দেশে। বছরের দ্বিতীয় মাসেই কভিড-১৯ মহামারিতে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয় ইউরোপের ইতালি, স্পেন, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। প্রতিদিন আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়তে থাকে বিশ্বের প্রায় সব দেশে। ঘরবন্দি হতে বাধ্য হয় প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার চরম শিখরে থাকা একবিংশ শতাব্দীর মানুষ।
এমন অভূতপূর্ব অবস্থার সঙ্গে পরিচিত ছিল না বিশ্ববাসী। ‘লকডাউন’ শব্দটি আগে ব্যবহূত হয়েছে কালেভদ্রে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে। এবার মানবসভ্যতার অদৃশ্য শত্রুর সঙ্গে লড়তে সেই ‘লকডাউন’ শব্দটি বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে চর্চিত শব্দে পরিণত হলো। মার্চ মাস পর্যন্ত চীন, পূর্ব এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে লকডাউনের খবর আসছিল। এর মধ্যে বাংলাদেশেও মার্চের শেষ থেকে কভিড-১৯-এর প্রকোপ বাড়তে থাকে। প্রতিদিন গড়ে ২৫ থেকে ৩০ জনের মৃত্যুর খবর আসতে থাকে। এ অবস্থায় এখানেও ‘লকডাউন’ ঘোষণা করা হয়। তবে সরকারের নানামুখী পদক্ষেপের কারণে বাংলাদেশে কভিড-১৯ ইউরোপ, আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মতো ভয়াবহ আকার ধারণ করেনি। তারপরও সাত হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন করোনাভাইরাসের ছোবলে।
শুধু জীবনযাপন নয়, বিশ্বব্যবস্থা বা ভূ-রাজনীতির ক্ষেত্রেও ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে ২০২০ সাল। গত এক দশক থেকে চীনের উত্থানের ফলে বিশ্ব অর্থনীতির ভরকেন্দ্র এশিয়ার দিকে চলে আসছিল। কিন্তু কভিড-১৯-এর মারাত্মক বিস্তারের পর এর টিকা আবিস্কার ও এর বিতরণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে পশ্চিমা দেশগুলোর অবস্থান সেই ভরকেন্দ্রকে আবারও ফিরিয়ে নিতে চলেছে পাশ্চাত্যের দিকে।
করোনাভাইরাসের প্রকোপজনিত অবস্থায় বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও অফিস, স্কুলসহ দৈনন্দিন কাজে অনলাইন মাধ্যমের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়। যেখানে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসেও দেশে ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ ব্যবহারের পরিমাণ এক হাজার জিবিপিএসের কম ছিল, সেখানে মে-জুন মাসেই তা এক হাজার পাঁচশ জিবিপিএসে পৌঁছে যায়। ডিসেম্বর মাসে এসে এই ব্যান্ডউইথ ব্যবহারের পরিমাণ দাঁড়ায় দুই হাজার একশ জিবিপিএস। তবে ডিজিটাল বাংলাদেশের মজবুত অবকাঠামো থাকায় বর্ধিত ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ চাহিদা মেটাতে কোনো সমস্যা হয়নি; বরং লকডাউনে নতুন করে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ই-কমার্স। স্মার্টফোন, ল্যাপটপের মতো ডিভাইসের বিক্রিও বেড়ে যায় স্বাভাবিকের চেয়ে দ্বিগুণ। ফলে ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহারে মানুষ অভ্যস্ত হয়ে ওঠে।
মহামারির এ সময় বছরজুড়েই প্রত্যাশা ছিল ভ্যাকসিনের। বিশ্বের বড় বড় দেশ থেকে ভ্যাকসিন আবিস্কারের কার্যক্রম শুরু হয়। এমনকি বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানি গ্লোব বায়োটেকও দেশেই ভ্যাকসিন তৈরির ঘোষণা দেয়। ফলে কভিড-১৯ ভ্যাকসিন উদ্ভাবনকারী দেশের তালিকায় বাংলাদেশও যুক্ত হয়। তবে বছর শেষে ভ্যাকসিনটির হিউম্যান ট্রায়াল শুরু হতে পারেনি অবশ্যপালনীয় কয়েকটি প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়ায়।
মুজিববর্ষ
এই মার্চ মাসেই বাংলাদেশ সরকারের ঘোষণা করা মুজিববর্ষ বিপুল আয়োজনে শুরু হওয়ার কথা ছিল।২০২০ ১৭ই মার্চ থেকে ২০২১ সালের ১৭ই মার্চ পর্যন্ত মুজিব বর্ষ ঘোষণা করে সরকার। দেশে বিদেশে ব্যাপকভাবে আয়োজনের প্রস্তুতি ছিল সরকারের।স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির প্রধান সমন্বয়ক ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী জানিয়েছিলেন, তাদের ব্যাপক প্রস্তুতির পর করোনাভাইরাসের কারণে সেটাকে কীভাবে পুন:বিন্যাস করার প্রয়োজন হয়েছে।”খারাপ লেগেছে পরিকল্পনা মত করতে পারিনি, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে পুনর্বিন্যাস করেছি। অনেক কিছু হচ্ছে অনলাইনে, টেলিভিশনে। কিছু প্রকাশনা হয়েছে। তবে হ্যাঁ, জনসমাগম করার যে পরিকল্পনা ছিল সেটা স্বাস্থ্য ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে করা হয়নি। আপনারা জানের প্রধানমন্ত্রী সময়সীমা বাড়িয়ে আগামী বছর ১৬ই ডিসেম্বর করেছেন। আমরা আশা করছি পরিস্থিতি ভাল হলে অনুষ্ঠান করতে পারবো” – বলছিলেন তিনি।
বাংলাদেশের সরকারের ঘোষণা করা মুজিববর্ষের ব্যাপক আয়োজন পুনর্বিন্যাস করতে হয় করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে।
বিপর্যস্ত শিক্ষাখাত
মহামারী করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে প্রায় ছয় মাস ধরে বন্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।সরাসরি পাঠদান দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকায় বিপর্যস্ত শিক্ষা খাত। প্রাক-প্রাথমিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীই ক্ষতিগ্রস্ত করোনার ছোবলে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের জন্য দীর্ঘদিন ধরে টেলিভিশনে পাঠদান চালু থাকলেও বর্তমানে শিক্ষার্থীরা এ ক্লাসে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর এখন এ ক্লাসে মনোযোগ নেই। একাদশের শিক্ষার্থীদের কলেজে ভর্তি বিলম্বের পাশাপাশি বাতিল করতে হয়েছে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষাও। করোনার কারণে এ বছর বাতিল হয়েছে পঞ্চম শ্রেণির প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী ও অষ্টম শ্রেণির জেএসসি, জেডিসি পরীক্ষাও।
দেশের সিংহভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন ক্লাস চলমান থাকলেও বেশির ভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে পাঠদান চলছে না। সে হিসেবে উচ্চবিদ্যাপীঠে অধ্যয়নরত বৃহদাংশ শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাসের বাইরে থেকে যাচ্ছেন। করোনাকালে সবকিছু স্বাভাবিক নিয়মে চলছে। তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সীমিত পরিসরে খুলে দেওয়ার দাবিতে ‘সাধারণ শিক্ষার্থী’রা মানববন্ধন করছেন।
ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড
বছর জুরে কয়েকটি ধর্ষণের ঘটনায় মানুষ ব্যাপক ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখায়।বছরের শুরুতেই একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনায় ব্যাপক বিক্ষোভ হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে।সন্ধ্যায় তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে চড়ে বান্ধবীর বাসায় যাচ্ছিলেন। উদ্দেশ্য একসাথে পরীক্ষার প্রস্তুতি নেবেন।সন্ধ্যা ৭টার দিকে তিনি কুর্মিটোলা এলাকায় বাস থেকে নামেন। সেখান থেকেই অজ্ঞাত এক ব্যক্তি তার মুখ চেপে ধরে পাশের একটি নির্জন স্থানে নিয়ে যায়। ঘটনার আকস্মিকতায় সেখানেই জ্ঞান হারান ছাত্রীটি। নির্যাতনের এক পর্যায়ে জ্ঞান ফিরে পান তিনি এবং আবার জ্ঞান হারান।
নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলায় এক নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ঘটনা ঘটে সেপ্টেম্বরের দিকে। অক্টোবরে সোশাল মিডিয়াতে দেড় মিনিটের একটা ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে আলোচনা শুরু হয়, আর মানুষ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে ঘটনার বিচার দাবি করে। পুলিশ জানায়, মাস খানেক আগে উপজেলার স্থানীয় কয়েকজন যুবক ওই গৃহবধূকে নির্যাতন করে।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নীনা গোস্বামী বলেছেন, ১০ বছর ধরে তারা প্রায় তিনশটি ধর্ষণের মামলায় আইনি সহায়তা দিচ্ছেন। কিন্তু বেশিরভাগ মামলারই বিচার শেষ করা যায়নি বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। “সমস্যাটা হচ্ছে, তদন্ত যিনি করছেন, তিনি তদন্তে সময় লাগাচ্ছেন। তিনি অনেকবার সময় নিয়ে তারপর হয়তোবা আদালতে চার্জশিট দিচ্ছেন।”
সিলেটের এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে এক তরুণী ধর্ষণের ঘটনায় সিলেট শহরের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করে সাধারণ মানুষ। সিলেটের টিলাগড় এলাকার এমসি কলেজের গেটের সামনে থেকে ঐ তরুণীকে তুলে নিয়ে যায় কয়েকজন। ঐ তরুণী তার স্বামীর সাথে একটি গাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। তরুণীর স্বামী এজাহারে উল্লেখ করেন, তার স্ত্রীকে যখন জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় তখন দুই ব্যক্তি তাকে গাড়িতে আটক করে রাখে।এর ঘণ্টাখানেক পর এমসি কলেজের ছাত্রাবাসের একটি কক্ষের সামনে থেকে নিজের স্ত্রীকে বিধ্বস্ত অবস্থায় উদ্ধার করেন স্বামী।
একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে প্রতিবাদ-আন্দোলনের মুখে এই অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা হয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে সংশোধনী এনে অধ্যাদেশের মাধ্যমে তা ইতিমধ্যে কার্যকর করা হয়েছে।
খালেদা জিয়ার মুক্তি
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট এবং চ্যারিটেবল ট্রাস্ট সম্পর্কিত দু’টি দুর্নীতির মামলায় ১৭ বছরের সাজা নিয়ে বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া কারাভোগ করছিলেন।দুইবছরের বেশি সময় কারাভোগের পর এই করোনাভাইরাস সংক্রমণকালে তাকে কারাভোগ স্থগিত করে মুক্তি দেয়া হয়। খালেদা জিয়ার মুক্তির পর তাঁর বোন সেলিমা ইসলাম বলেছেন, তাদের আবেদনের পাশাপাশি করোনাভাইরাস পরিস্থিতি তার মুক্তির বিষয়টি তরান্বিত করেছে বলে তারা মনে করেন। করোনাভাইরাসের কারণে শিক্ষা ব্যবস্থায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আগামী বছরের ১৬ই জানুয়ারি পর্যন্ত বন্ধ থাকার কথা বলেছে সরকার।
মেজর সিনহা হত্যাকান্ড
বছরের আলোচিত ঘটনার মধ্যে একটা হত্যাকাণ্ড পুলিশ প্রশাসনের মধ্যে ব্যাপক রদবদল ঘটায়। সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান ৩১শে জুলাই কক্সবাজারের টেকনাফে পুলিশের গুলিতে নিহত হন। হত্যার অভিযোগে টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাসসহ ১৫ জনকে আসামী করে চার্জশীট দেয়া হয়েছে।
গত ৩১শে জুলাই কক্সবাজারের টেকনাফে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান।এদের মধ্যে ১৪ জনকেই গ্রেফতার করা হয়েছে এবং তারা এখন কারাগারে রয়েছে। র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ সংবাদ সম্মেলন করে জানান এই হত্যাকাণ্ড ছিল পরিকল্পিত। মেজর সিনহা হত্যার পর পুলিশ এবং সেনাপ্রধান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে।তাদের দুই বাহিনীর পক্ষ থেকে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য দেয়া হয়। নিরপত্তা বিশ্লেষকরা প্রশ্ন তোলেন দুই বাহিনীর মধ্যে দুরত্ব তৈরি হচ্ছে কিনা। এই ঘটনায় কক্সবাজারে জেলায় পুরো পুলিশ প্রশাসনে রদবদল করা করা হয়।
ইতিবাচক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি
করোনাভাইরাসের কারণে সব খাতে নেতিবাচক প্রভাব পরলেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল ইতিবাচক।অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বিগত ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ অর্জিত হয়েছে। স্থির মূল্যে এই জিডিপির আকার দাঁড়িয়েছে ২৭ লাখ ৯৬ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা।আর মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়ে ২ হাজার ৬৪ ডলারে উন্নীত হয়েছে।বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রাথমিক এই তথ্য প্রকাশ করেছে। সারা বিশ্ব যখন করোনা ভাইরাসের প্রকোপে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ধ্বসে পড়েছে সেখানে বাংলাদেশ প্রবৃদ্ধির হার ইতিবাচক থাকার কারণ হিসেবে কয়েকটা বিষয়কে উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ।”কৃষিখাত, কল-কারখানায় শ্রমিকদের কাজে ফেরা, সঠিক পথে রেমিটেন্সের পাঠানো অব্যাহত ছিল বলে প্রবৃদ্ধি হার ইতিবাচক ছিল” বলছিলেন তিনি।
রহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর শুরু
৪ ডিসেম্বর কক্সবাজারের শরণার্থী শিবির থেকে স্থানান্তরের প্রথম ধাপে বঙ্গোপসাগরের দ্বীপ ভাসানচরে পৌঁছায় ১ হাজার ৬৪২ জন রোহিঙ্গা। আগেরদিন ভাসানচরে যেতে আগ্রহী এসব রোহিঙ্গাদের কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে গাড়িতে এনে চট্টগ্রামে শাহিন স্কুলের ট্রানজিট ক্যাম্পে রাখা হয়েছিল। এর পর স্বেচ্ছায় যেতে ইচ্ছুক প্রায় ৬শ’ রোহিঙ্গা নিয়ে দ্বিতীয় দফায় নোয়াখালীর ভাসনচরের নিয়ে যাওয়া হয়।
আশার আলো পদ্মা সেতু
এই অতিমারির মধ্যেও বাংলাদেশের জন্য আশা বয়ে আনে বছরের শেষ মাসে দেশের সুদীর্ঘ পদ্মা সেতুর সর্বশেষ ৪১তম স্প্যান বসানোর সংবাদ। এর মাধ্যমে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে ছয় হাজার ১৫০ মিটারের পুরো সেতু। নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত এ সেতু দেশের ভাবমূর্তিকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও উজ্জ্বল করে তুলেছে। আগামী বছরের জুনে এ সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।
পদ্মা সেতু বাংলাদেশের পদ্মা নদীর ওপর নির্মাণাধীন একটি বহুমুখী সড়ক ও রেল সেতু। এর মাধ্যমে মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের সঙ্গে শরীয়তপুর ও মাদারীপুর যুক্ত হবে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের সঙ্গে উত্তর-পূর্ব অংশের সংযোগ ঘটবে এই সেতুর মাধ্যমে।
ভাস্কর্য ইস্যু
বছরের শেষ দিকে ভাস্কর্য ইস্যু নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ এবং ইসলামপন্থী-দলগুলো কঠোর অবস্থান নেয়। ঢাকার দক্ষিণে ধোলাইপাড় মোড়ে শেখ মুজিবুর রহমানের একটি ভাস্কর্য নির্মাণকে কেন্দ্র করে ইসলামপন্থী কয়েকটি দল ঐ এলাকায় সমাবেশ করে।এই দলগুলো শেখ মুজিবের ভাস্কর্যকে ‘মূর্তি’ আখ্যা দিয়ে এর নির্মাণ বন্ধ করা না হলে আরও কর্মসূচি দেয়ার হুমকি দেয়। ডিসেম্বরের ৪ তারিখে ভাষ্কর্য বিরোধী মিছিল বের করলে পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করে। বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মামুনুল হক বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, দেশে ইসলামি অনুশাসন চালু হলে ভাস্কর্য রাখার অবকাশ থাকবে না। ভাস্কর্যের পক্ষে আওয়ামী লীগ সমমনা বিভিন্ন গোষ্ঠী প্রতিবাদ জানায়। এরই মধ্যে কুষ্টিয়াতে শেখ মুজিবর রহমানের নির্মাণাধীন একটা ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেললে পরিস্থিতি চরমে পৌছায়। পুলিশ এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে চারজনকে আটক করে। ভাস্কর্য ভাঙার প্রতিবাদে সারা দেশে সরকারি আমলারা এক নজিরবিহীন সম্মেলন করেন। ভাস্কর্যের স্থানে মুজিব মিনার করার দাবি জানায় ঐ দলগুলো। কিন্তু সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে ভাস্কর্য তৈরির পক্ষেই অনড় অবস্থানে দেখা যায়। এক পর্যায়ে প্রথমবারের মত বেশ কিছু ইসলামী চিন্তাবিদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি জানান দুই পক্ষের আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে আসা যাবে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন “সংবিধানের বাইরে যাবো না, কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানবো না। মিনার নাকি ভাস্কর্য সে ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত হয় নি। ২০২০ সালে ঘটনাগুলোর মধ্যে ভাস্কর্য ইস্যু এখনো একটা চলমান বিষয়। আরো বৈঠক হবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। সূত্র: বিবিসি বাংলা