প্রতিদিনই টিকাকেন্দ্রে ভিড় বাড়ছে। টিকা গ্রহণের জন্য মানুষের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়েছে। কারণ টিকা গ্রহণের পর সবাই সুস্থ আছেন। টিকা গ্রহণের পর অল্প সংখ্যক মানুষের শরীরে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিলেও তা ছিল মৃদু। প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে তারাও এখন সুস্থ আছেন।
এর মধ্য দিয়ে টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে জনমনে যে সংশয় তৈরি হয়েছিল তা কেটে গেছে। ফলে টিকা গ্রহণে মানুষের স্বতঃস্ম্ফূর্ত সাড়া মিলেছে। প্রত্যেকটি কেন্দ্রে টিকা গ্রহীতাদের উপচেপড়া ভিড়। কর্তৃপক্ষ ভিড় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। টিকাকেন্দ্রে ভিড় সামলানোই এখন সরকারের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ।
টিকাদানের পঞ্চম দিনে গতকাল সারাদেশে দুই লাখ চার হাজার ৫৪০ জন টিকা নিয়েছেন। আগের দিন বুধবার এ সংখ্যা ছিল এক লাখ ৫৮ হাজার ৪৫১ জন। অর্থাৎ, গত পাঁচ দিনের হিসাব পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রতিদিনই টিকাদানের হার ব্যাপকভাবে বেড়েছে। ভিড় সামলাতে টিকাকেন্দ্রে আপাতত নিবন্ধন স্থগিত করা হয়েছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, নিবন্ধন না করেও অনেকে টিকা নিতে আসায় প্রায় সব কেন্দ্রে অতিরিক্ত ভিড় তৈরি হয়েছে। এতে টিকাদান কার্যক্রম স্বতঃস্ম্ফূর্ত রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে। এ কারণে আপাতত টিকাকেন্দ্রে নিবন্ধন সুবিধা স্থগিত করা হয়েছে। তবে প্রয়োজন হলে আবারও কেন্দ্রে নিবন্ধনের ব্যবস্থা চালু করা হবে। শুরুতে টিকাদান
কর্মসূচি সফল হওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিল সরকার। কারণ টিকা গ্রহণে মানুষের মধ্যে অনীহা ছিল। টিকা নিতে নিবন্ধনেও সাড়া মিলছিল না।
প্রথমে ৫৫ বছরের ওপরে নাগরিকদের নিবন্ধনের সুযোগ রাখা হয়েছিল। কিন্তু টিকা গ্রহণে মানুষের সাড়া কম থাকায় গত সোমবার মন্ত্রিসভা বৈঠকে টিকা গ্রহণের বয়সসীমা ৫৫ থেকে কমিয়ে ৪০ বছর করা হয়। অর্থাৎ, ৪০ বছর থেকে শুরু করে তার ওপরের বয়সী নাগরিকরা টিকার জন্য আবেদন করতে পারবেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে কেন্দ্রে তাৎক্ষণিক নিবন্ধন করে টিকাদানের নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে জারি করা এ-সংক্রান্ত নির্দেশনায় বলা হয়, জাতীয় পরিচয়পত্র সঙ্গে নিয়ে টিকাকেন্দ্রে গেলে সেখানেই তাৎক্ষণিক নিবন্ধন করে টিকাদানের ব্যবস্থা করা হবে। এর পরই মূলত টিকাকেন্দ্রে ভিড় বাড়তে থাকে। কয়েকদিন ধরে অধিকাংশ মানুষই জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে টিকাকেন্দ্রে উপস্থিত হন। এতে প্রত্যেকটি টিকাকেন্দ্রে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত মানুষ ভিড় করে।
টিকাকেন্দ্র আছে রাজধানীর এমন অন্তত পাঁচটি হাসপাতালের পরিচালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাৎক্ষণিক নিবন্ধনের সুযোগ রাখায় টিকাকেন্দ্র তিন দিন ধরে মানুষের ভিড় সামলাতে তাদের হিমশিম খেতে হয়েছে। অনলাইন নিবন্ধনের সুযোগ থাকা অনেক লোকও শুধু জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে কেন্দ্রে উপস্থিত হন। তাৎক্ষণিক নিবন্ধন করে তাদের টিকা দেওয়া হয়। কিন্তু সুরক্ষা ওয়েবসাইটে নিবন্ধন করে কেন্দ্রে আসা অনেকে টিকা পাননি। এতে করে অনেক স্থানে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। টিকাদান কর্মসূচি সমন্বয় করাও কঠিন হয়ে পড়ে। প্রতিদিনই ভিড় বাড়ছিল। টিকাদান কর্মসূচি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে তারাই কর্তৃপক্ষের কাছে টিকাকেন্দ্রে নিবন্ধনের সমস্যার বিষয়টি উপস্থাপন করেন।
এর পরই স্বাস্থ্য বিভাগ কর্তৃপক্ষ টিকাদান পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনে। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী, আপাতত টিকাকেন্দ্রে তাৎক্ষণিক নিবন্ধন স্থগিত করা হয়েছে। এখন থেকে সুরক্ষা নামের ওয়েবসাইটে টিকা পেতে আবেদন করতে হবে। এরপর মোবাইল ফোনে এসএমএসের মাধ্যমে টিকাদানের সময় জানানো হবে। ওই এসএমএস পেতে টিকা গ্রহীতাকে দুই থেকে তিন দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। টিকা গ্রহণের স্থান ও তারিখের এসএমএস পাওয়ার পর টিকা গ্রহীতা ব্যক্তি নির্ধারিত দিনে ওই কেন্দ্রে গিয়ে টিকা নিতে পারবেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম বলেন, সরকারের লক্ষ্য টিকাদান কর্মসূচি স্বতঃস্ম্ফূর্ত রাখা। মানুষ যাতে উৎসবমুখর পরিবেশে টিকা নিতে পারেন তা নির্বিঘ্ন করার লক্ষ্যে প্রয়োজন অনুযায়ী পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনা হবে।
পাঁচ দিনে টিকাদান পাঁচ লাখ ছাড়াল :সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত টিকা নিলেন পাঁচ লাখ ৪২ হাজার ৩০৯ জন। তাদের মধ্যে তিন লাখ ৮৬ হাজার ৫৭৮ জন পুরুষ এবং এক লাখ ৫৫ হাজার ৭৩১ জন নারী। টিকা গ্রহণের পর গতকাল মাত্র ৮৬ জনের শরীরে সামান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত টিকা গ্রহণের পর ৩৬৩ জনের শরীরে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। তবে তা গুরুতর নয় বলে নিশ্চিত করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ কর্তৃপক্ষ। এদিকে টিকা পেতে নিবন্ধনকারীর সংখ্যাও হু হু করে বাড়ছে। গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত ১২ লাখ ৩৭ হাজারের বেশি মানুষ টিকা পেতে সুরক্ষা ওয়েবসাইটে নিবন্ধন করেছেন বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএস শাখার পরিচালক ডা. মিজানুর রহমান।
টিকাকেন্দ্রে নিবন্ধন নয়- স্বাস্থ্যমন্ত্রী :স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক গতকাল রাজধানীর একটি পাঁচতারা হোটেলে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বলেন, প্রত্যন্ত এলাকার মানুষ, বিশেষ করে যাদের স্মার্টফোন নেই, তাদের জন্য টিকাকেন্দ্রে এসে নিবন্ধনের সুযোগ রাখা হয়েছিল। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ কেন্দ্রে এসে নিবন্ধন করাচ্ছেন। এতে টিকাকেন্দ্রে দায়িত্বরতদের ওপর চাপ তৈরি হচ্ছে। এ অবস্থায় টিকাদান কর্মসূচি স্বাভাবিকভাবে চালাতেই আপাতত টিকাকেন্দ্র নিবন্ধন সুবিধা স্থগিত করা হয়েছে।
জাহিদ মালেক বলেন, উৎসবমুখর পরিবেশে টিকাদান কর্মসূচি অব্যাহত রাখা সরকারের লক্ষ্য। টিকাদানের একটি সুন্দর পরিবেশ স্বাস্থ্য বিভাগ তৈরি করে দিয়েছে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, টিকাকেন্দ্রে নিবন্ধনকারীর সংখ্যাই বেশি। অনলাইনে যারা নিবন্ধন করছেন, তারা টিকাকেন্দ্রে প্রবেশ করতেই পারছেন না। বয়স্ক মানুষের কষ্ট হচ্ছে। একই সঙ্গে টিকাদান কর্মসূচির সঙ্গে সংশ্নিষ্ট চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদেরও কষ্ট হচ্ছে। এ কারণেই টিকাকেন্দ্রে আপাতত নিবন্ধন স্থগিত করা হয়েছে।
এদিকে সরকারের কিনে আনা টিকা দেওয়া হবে বেসরকারি হাসপাতালেও। বেসরকারি হাসপাতালগুলো সরকার থেকে টিকা কিনে নেবে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, তাদের আমরা বেশি টিকা দেব না। তারা চাচ্ছে, তাই অল্প টিকা দেব। তাতে আমাদেরও লোড কম হবে। যাদের ভালো হাসপাতাল আছে, শুধু তাদের এই ভ্যাকসিন দেওয়া হবে।