প্রতি বছরই বাড়ে অভিযোগের সংখ্যা। ২০১৯ সালের হিসাবে দুদকে ২১ হাজার ৩৭১টি অভিযোগ জমা পড়ে। তবে মাত্র ১ হাজার ৭১০টি অভিযোগ আমলে নিয়ে অনুসন্ধান করছে সংস্থাটি। সংস্থাটির একটি সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে। দুদক সূত্র জানায়, ২০১৮ সাল থেকে ২০১৯ সালে অভিযোগ বেড়েছে ২৯ শতাংশ। অন্যদিকে অনুসন্ধানের জন্য অভিযোগ গ্রহণে কোনো পরিবর্তন আসেনি। সূত্র জানায়, ২০১৯ সালে দুদকে অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়ে।
এদের মধ্যে রয়েছেন বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্য, আমলা ও সরকারি কর্মকর্তা। যাদের ইতিমধ্যেই দুদকের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে অনেককেই। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পর অনুসন্ধানও চলমান। তবে সংসদ সদস্যসহ ক্ষমতাবান অনেক ব্যক্তির বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শেষ না হওয়ায় নানা মহলে প্রশ্নও ওঠে প্রায়শই। এদিকে, এতো এতো অভিযোগের ভিড়ে মাত্র কিছুসংখ্যক অভিযোগ আমলে নিয়ে অনুসন্ধানের বিষয়টি নিয়েও প্রায়ই প্রশ্নের মুখে পড়ে দুদক। এক্ষেত্রে সংস্থাটির চেয়ারম্যানসহ উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা বরাবরই বলছেন, যেসব অভিযোগ দুদকের তফসিলভুক্ত সেগুলোই অনুসন্ধানের আওতায় আনা হয়।
সংস্থাটি জানায়, এক বছরে বিভিন্ন অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় সাজা দেয়া হয়েছে। তবে এই হার ২০১৯ সালের মতোই ৬৩ শতাংশ। অবশ্য সংস্থাটির দাবি, দুদকের মামলায় এক সময় সাজার হার ২০ শতাংশে নেমে এসেছিল। বর্তমান কমিশন দুদকের প্রসিকিউশন ব্যবস্থায় ব্যাপক সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করে। কমিশন বিভিন্ন অভিযোগে ২০ জন আইনজীবীকে অপসারণ করে। আইনজীবী নিয়োগের নীতিমালা প্রণয়ন এবং কার্যকর করেছে। কমিশনের মামলায় সাজার হার বিগত তিন বছর ধারাবাহিকভাবে ৬০ শতাংশের উপরে রয়েছে।
এ ছাড়া দেশের মানুষের কাছ থেকে দুর্নীতির অভিযোগ গ্রহণের জন্য সংস্থাটি একটি বিশেষ হটলাইন (১০৬) চালু করে। হটলাইনে ২০১৯ সালেই ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫২৪টি ফোন কল পায় দুদক। এর মাধ্যমে ১ হাজারের বেশি অভিযান পরিচালনা করা হয়। এজন্য দুদক একটি এনফোর্সমেন্ট ইউনিট গঠন করেছে। দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের তথ্য সংগ্রহে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগ বিএফআইইউ’র সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদানে চুক্তি করে সংস্থাটি। নতুন অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী মহাপরিচালক থেকে উপসহকারী পরিচালক পর্যন্ত অনুসন্ধান ও তদন্তে যুক্ত কর্মকর্তার সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ করা হয়।
এদিকে করোনাকালে ত্রাণ সামগ্রী আত্মসাতের অভিযোগে দুদক ২০টিরও বেশি মামলা দায়ের করেছে। এসব মামলার আসামিদেরও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বলা চলে এক্ষেত্রে কমিশন দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতার নীতি দৃঢ়তার সঙ্গে পালন করেছে। করোনাকালে স্বাস্থ্যখাতে চাঞ্চল্যকর কিছু দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে। প্রতিটি ঘটনা কমিশন আমলে নিয়েছে এবং অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। ইতিমধ্যেই কোভিড টেস্ট জালিয়াতির অভিযোগে রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যানসহ অন্যান্যদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের নকল মাস্ক দিয়ে যে বা যারা তাদের মৃত্যুমুখে ঠেলে দিয়েছিল তাদের বিরুদ্ধেও মামলা দায়ের করা হয়েছে। আসামিদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। একাধিকবার তাদের জিজ্ঞাসাবাদের আওতায় আনা হচ্ছে বলেও জানায় দুদক।
দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ ২০১৬ সালের ১৪ই মার্চ দায়িত্ব গ্রহণ করেন। একই দিনে কমিশনার হিসেবে যোগ দেন সাবেক জেলা জজ এ এফ এম আমিনুল ইসলাম। এর প্রায় দুই বছর পরে কমিশনার হিসেবে যোগ দেন জনপ্রশাসনের সাবেক সিনিয়র সচিব ড. মো. মোজাম্মেল হক খান। ইকবাল মাহমুদের নেতৃত্বে এই দুই কর্মকর্তা কমিশনকে আরো শক্ত অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য একাধিক পরিকল্পনা করেন। চেয়ারম্যান শুরুতেই প্রতিষ্ঠানটির কাঠামোগত দিকের প্রতি নজর দেন। দুদকের নেয়া সমন্বিত কৌশলপত্রে দুর্নীতি দমন, প্রতিরোধ ও পদ্ধতিগত সংস্কারের মাধ্যমে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে বিজনেস প্রসেস রি-ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মতো যুগান্তকারী কৌশল গ্রহণ করা হয়। একই সঙ্গে দুদককে একটি শক্তিশালী সংস্থা হিসেবে দাঁড় করাতে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা গ্রহণ করে কমিশন। সেই পরিকল্পনায় যেসব বিষয়কে প্রধান্য দেয়া হয়েছিল পর্যায়ক্রমে তার বেশির ভাগই বাস্তবায়ন করা হয়। এফবিআই ও সিবিআইয়ের অনুসন্ধান কাজের সঙ্গে মিল রেখে দুদকে গঠন করা হয় পৃথক গোয়েন্দা বিভাগ। গোয়েন্দা বিভাগের কাজ জেলা পর্যায়েও সম্প্রসারণ করার পাশাপাশি অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ পরিচালনা করছে। জেলা গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তারা গোপন অনুসন্ধান প্রতিবেদন প্রধান কার্যালয়ে পাঠান। তালিকায় যাদের নাম আসে কমিশন যাচাই-বাছাই করে তাদের বিরুদ্ধে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করে। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে শুধু মামলা দায়ের নয়, আসামিদের গ্রেপ্তার, দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা আরোপসহ মামলায় সংশ্লিষ্ট অবৈধ সম্পদ জব্দ করার ক্ষেত্রে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করে কমিশন। ইকবাল মাহমুদ যোগদানের প্রথম বছরেই বিভিন্ন দুর্নীতির মামলায় প্রায় ৪০০ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়। বর্তমান কমিশনের সময়ে অন্তত এক হাজার ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে দুদক। পিকে হালদারসহ পাঁচ শতাধিক আলোচিত ব্যক্তির সম্পদ জব্দ করে সংস্থাটি।