দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বন্যাকবলিত এলাকায় পানি কমতে শুরু করেছে। তবে এসব এলাকায় বাড়ছে রোগ বালাই। বিশেষ করে পানিবাহিত রোগ, শ্বাসতন্ত্রের জটিলতার মতো সমস্যাগুলো বাড়ছে। আক্রান্তদের মধ্যে অধিকাংশই শিশু। বন্যায় স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় মিলছে না চিকিৎসা। মিলছে না পর্যাপ্ত ওষুধও।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, পানিবাহিত রোগ- যেমন ডায়রিয়া, শ্বাসতন্ত্রের জটিলতা, পানিতে ডুবা, সাপের কামড়, বজ্রপাতে মৃত্যুও হয়েছে অনেকের। বন্যাকবলিত এলাকায় প্রায় সাড়ে ৫শ সরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে জেলা সদর হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র ও কমিউনিটি ক্লিনিক। পানি কমতে থাকায় ফেনীতে কয়েকটি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান চালু করা সম্ভব হয়েছে।
কন্ট্রোল রুম থেকে জানানো হয়, গতকাল (শুক্রবার ৩০ আগস্ট) বিকেল ৫টা পর্যন্ত ডায়রিয়া, রেসপাইরেটরি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন (আরটিআই), বজ্রপাত, সাপে কাটা, পানিতে ডোবা আর আঘাত প্রাপ্ত হয়ে ৪২ জনের মৃত্যুর তথ্য আছে কন্ট্রোল রুমে। এর মধ্যে ২৩ জনই পানিতে ডুবে মারা গেছে। সাপের কামড়ে ১ জন, বজ্রপাতে ১ জন, ডায়রিয়াতে ৩ জন, আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে ৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। তবে এটিই প্রকৃত চিত্র নয় বলে জানানো হয় কন্ট্রোল রুম থেকে। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান প্লাবিত হওয়ায় সেখানাকার কার্যক্রম যেমন নেই; তেমনি অনেক তথ্যও মিলছে না। এছাড়া সিলেট ও চট্টগ্রামের বন্যা পরিস্থিতির তথ্যের সঙ্গে চলমান বন্যা পরিস্থিতির তথ্যগুলো সংযুক্ত করা হয়। আক্রান্তের বিষয়টি আলাদা করা হচ্ছে না।
চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বন্যায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মানুষের নানা স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি হয়। শুধু যে বন্যা কবলিত এলাকার মানুষই এ ঝুঁকিতে থাকে, তা নয়। বন্যার্ত এলাকায় যারা কাজ করেন যেমন-উদ্ধারকর্মী, ত্রাণকর্মী, স্বাস্থ্যসেবা দানকারীরও ঝুঁকি থাকে। পানি পুরোপুরি নেমে গেলে বন্যাপরবর্তী রোগ বালাই বিশেষ করে পানি বাহিত রোগ বাড়ে। ঘরবাড়ি স্যাঁতসেঁতে হওয়ার কারণে ত্বকে ছত্রাকজাতীয় সংক্রমণ বাড়ে। এছাড়া বন্যার পর ডেঙ্গু, চিকনগুনিয়া, ম্যালেরিয়ার মতো মশাবাহিত রোগের প্রকোপও বেড়ে যায়। তাই এসব রোগের প্রকোপ মোকাবিলায় প্রস্তুতির পাশাপাশি সাবধান হওয়ারও পরামর্শ দেন তারা।
পরিস্থিতি মোকাবিলায় স্বাস্থ্য বিভাগের প্রস্তুতি রয়েছে বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে বলা হচ্ছে। তাছাড়া বন্যার কারণে স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের কী কী ক্ষতি হয়েছে এর একটা তালিকা করে পাঠানোর জন্যও সিভিল সার্জনদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
আমাদের নোয়াখালী প্রতিনিধি জানান, নোয়াখালীর আশ্রয়কেন্দ্রে ও পানিবন্দি বাড়িঘরে শিশুদের অসুস্থতা বাড়ছে। জেলা সিভিল সার্জন মাসুম ইফতেখার জানান, বন্যাকবলিত এলাকার প্রতিটি আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে দুর্গত মানুষকে সেবা দেয়ার পাশাপাশি পানি বিশুদ্ধকরণ বড়ি, খাওয়ার স্যালাইনসহ প্রয়োজনীয় ওষুধ দেয়া হচ্ছে।
ফেনী প্রতিনিধি জানান, ফেনী সদরের ফাজিলপুর, লেমুয়া, ছাগলনাইয়ার বিভিন্ন এলাকার বিভিন্ন অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে, শিশুরা জ্বর ও সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত। ফেনী জেলার সিভিল সার্জন শিহাব উদ্দিন জানান, ডায়রিয়া, জ্বর, সর্দি-কাশির রোগী তারা বেশি পাচ্ছেন। শিশুরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে।
লক্ষীপুর প্রতিনিধি জানান, দূষিত পানি পান ও বন্যার পানি মাড়িয়ে চলাফিরা করার কারণে পানিবাহিত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন বন্যার্ত মানুষ। লক্ষীপুরের সিভিল সার্জন আহাম্মদ কবীর জানান, স্বাস্থ্যকর্মীরা নৌকায় করে দুর্গম এলাকায় বানভাসিদের বাড়িতে গিয়ে খোঁজখবর নিচ্ছেন এবং প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র দিচ্ছেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ বলেন, বন্যা বা ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী সময়ে পানি দূষণ আমাদের সবচেয়ে বড় আতংকের বিষয়। আর বন্যার পর সবচেয়ে ভয়াবহ রোগ হচ্ছে ডায়রিয়া এবং কলেরা। বন্যায় খাবার পানির উৎসগুলো দূষিত হয়ে পড়ে। ফলে বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দেয়। পানিবাহিত রোগগুলো বাড়ে। এছাড়া বন্যার পর আরো কিছু রোগ যেমন- শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ, নিউমোনিয়া, এজমা, চর্মরোগ হতে পারে। বন্যাপরবর্তী সময়ে রোগ প্রতিরোধের বিষয়ে আমাদের এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। কেউ আক্রান্ত হলে তার চিকিৎসা, বন্যা উপদ্রুত এলাকার টিউবওয়েলগুলোকে জীবাণুমুক্ত করা এবং সবার জন্য নিরাপদ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি। পাশাপাশি পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট সরবরাহ করতে হবে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী জানান, বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর মশাবাহিত বিভিন্ন রোগ যেমন- ডেঙ্গু, চিকনগুনিয়া বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। তিনি বলেন, বন্যার পানি কমে গিয়ে বিভিন্ন জায়গায় পানি আটকে থাকে। এই জমে থাকা পানিতে মশার বংশ বিস্তার হতে পারে। ফলে মশাবাহিত রোগ বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় আগাম প্রস্তুতি নেয়ার তাগিদ দেন তিনি।