মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয়ের ৪৯তম বার্ষিকীর প্রাক্কালে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেন, “বাংলাদেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ, ধর্মান্ধ নয়। ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার করবেন না।” ” এ দেশে ‘ধর্মের নামে কোনো বিভেদ’ সৃষ্টি করতে তিনি দেবেন না।”
শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ, ধর্মান্ধ নয়। ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার করবেন না। প্রত্যেককে নিজ নিজ ধর্ম পালনের অধিকার রাখেন। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান- সকল ধর্মের-বর্ণের মানুষের রক্তের বিনিময়ে এ দেশ স্বাধীন হয়েছে।
শেখ হাসিনা আরও বলেন, ১৯৭১’র পরাজিত শক্তির একটি অংশ মিথ্যা, বানোয়াট, মনগড়া বক্তব্য দিয়ে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের বিভ্রান্ত করতে ইদানিং মাঠে নেমেছে। সমাজে অশান্তি সৃষ্টি করতে চাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, জাতির পিতা ১৯৭২ সালে বলেছিলেন ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার না করতে। কিন্তু পরাজিত শক্তির দোসররা দেশকে আবার ৫০ বছর আগের অবস্থায় ফিরে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে। রাজনৈতিক মদদে সরকারকে ভ্রুকুটি দেখানোর পর্যন্ত ধৃষ্টতা দেখাচ্ছে।
বিজয় দিবস উদযাপন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইতিহাসের এক বিশেষ সন্ধিক্ষণে আজ আমরা বিজয় দিবস-২০২০ উদযাপন করতে যাচ্ছি। এ বছর আমরা আমাদের মহান নেতা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করছি। কয়েকদিন পর আমরা আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে পদার্পন করবো। আমরা স্বল্পোন্নত দেশ হতে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা লাভ করেছি।
শেখ হাসিনা বলেন, গোটা জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে আমরা করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবিলা করে সমগ্র বিশ্বের বুকে নতুন উদাহরণ সৃষ্টি করেছি। প্রমত্তা পদ্মার বুক চিরে নিজেদের অর্থায়নে নির্মাণাধীন পদ্মাসেতু মাত্র সপ্তাহ খানেক আগে দেশের দুই প্রান্তকে সংযুক্ত করেছে। পৃথিবীর বুকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার প্রত্যয় নিয়ে দেশ এবং দেশের বাইরে অবস্থানরত বাংলাদেশের সকল নাগরিককে আমি বিজয় দিবসের আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।
প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে বলেন, আজকের এই মহান দিনে আমি মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাদানকারী বিভিন্ন দেশ ও দেশের জনগণ, ব্যক্তি এবং সংগঠনের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বীর সদস্য আমাদের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। তাদের প্রতি আমি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি ভারতের তৎকালীন সরকার, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং সর্বোপরি সাধারণ জনগণকে- যারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন জানিয়েছিলেন এবং নানাভাবে সহযোগিতা করেছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী করোনাভাইরাস-সহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে এ বছর যে সব রাজনীতিক, সংসদ সদস্য, বরেণ্য ব্যক্তিসহ সর্বস্তরের মানুষ মারা গেছেন, তাদের সবার আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এক পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এ বছর আমাদের বিজয় দিবস উদযাপন করতে হচ্ছে। করোনাভাইরাসের মহামারির কারণে আমাদের দৈনন্দিন কার্যপ্রণালীতে পরিবর্তন আনতে হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে, জনসমাগম এড়িয়ে আমাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় কাজকর্ম সম্পন্ন করতে হচ্ছে।
শেখ হাসিনা বলেন, প্রতিটি মানুষের জীবনই মহা মূল্যবান। কোনো অবহেলায় একজন মানুষেরও মৃত্যু কাম্য নয়। তাই, আমি সকলকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিজয় দিবস উদযাপনসহ যাবতীয় কাজকর্ম সম্পন্ন করার অনুরোধ জানাচ্ছি। আপনারা ঘর থেকে বের হওয়ার সময় অবশ্যই মাস্ক পরিধান করবেন এবং মাঝেমধ্যে হাত সাবান অথবা স্যানিটাইজার দিয়ে পরিষ্কার করবেন। আপনার সুরক্ষা, সকলের জন্য রক্ষাকবচ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা যখন যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে ব্যস্ত, দেশের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন, তখনই পরাজিত শক্তির দোসররা ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট তাকে সপরিবারে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে শুধু একজন ব্যক্তি মুজিবের মহাপ্রয়াণ হয়নি। তাকে হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে প্রশ্নবিদ্ধ করার প্রয়াস চালানো হয়।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে বাঙালি জাতির যে সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রা সূচিত হয়েছিল, তা স্তব্ধ করে দেওয়া হয়। তাকে হত্যার মাধ্যমে একটি আদর্শ ও স্বপ্নের অপমৃত্যু ঘটানো হয়। যে স্বপ্নের সঙ্গে জড়িয়েছিলেন এ দেশের লক্ষ-কোটি সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের ভাগ্য। সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ধর্ম নিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী জাতির পিতা ইসলাম ধর্মীয় মূল্যবোধ রক্ষা এবং প্রসারে যা করেছেন, ইসলামের নামে মুখোশধারী সরকারগুলো তা কখনই করেনি। আইন করে মদ-জুয়া-ঘোড়দৌড় নিষিদ্ধ করা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করা, মাদ্রাসা বোর্ড স্থাপন, ওআইসি’র সদস্যপদ অর্জনের মত কাজগুলো বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই বাস্তবায়িত হয়েছিল স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে।
শেখ হাসিনা বলেন, মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী-শক্তির মদদদাতা জিয়াউর রহমানের সব ধরনের বাধা উপেক্ষা করে বাংলার মানুষের এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে এসে আমি দলের দায়িত্ব গ্রহণ করি। পিতার আদর্শকে ধারণ করে বাংলার মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর ব্রত নিয়ে কাজ শুরু করি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু বলতেন ভিক্ষুক জাতিকে কেউ সম্মান করে না। আমরা বাংলাদেশের সেই দুর্নাম ঘুচিয়েছি। আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশ আজ একটি সমীহের নাম। আজকের বাংলাদেশ আর অর্থনৈতিকভাবে ভঙ্গুর বাংলাদেশ নয়। আজকের বাংলাদেশ স্বাবলম্বী বাংলাদেশ। একটা সময় ছিল আমাদের উন্নয়ন বাজেটের সিংহভাগ আসতো বিদেশি অনুদান থেকে। আজ বাজেটের ৯৭ ভাগ মেটানো হয় নিজস্ব অর্থায়নে। বাংলাদেশ কারও দয়া বা করুণার উপর নির্ভরশীল নয়।
তিনি বলেন, আমরা স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে সামিল হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছি। জাতির পিতার স্বপ্ন ছিল ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার। আমরা তার স্বপ্ন বাস্তবায়নের দ্বারপ্রান্তে। উন্নয়নের এই ধারাবাহিকতা আমাদের অব্যাহত রাখতে হবে। তবেই ২০৪১ সালের মধ্যে আমাদের উন্নত, সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হবে।
শেখ হাসিনা আরও বলেন, চলতি বছর আমরা জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানমালা উদযাপন করছি। যদিও করোনাভাইরাসের কারণে আমাদের কর্মসূচিতে কিছুটা পরিবর্তন আনতে হয়েছে। আগামী বছর আমাদের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি। করেনাভাইরাসের এই মহামারি না থাকলে আমরা যথাযথ উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব উদযাপন করবো, ইনশাআল্লাহ। একইসঙ্গে চলবে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানমালা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিজয় দিবসের প্রাক্কালে আসুন, আবারও আমরা শপথ নেই- আমরা যেন লাখো শহীদের রক্তের ঋণ ভুলে না যাই। আমরা যেন মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনা ভূলুণ্ঠিত হতে না দেই। যুবশক্তি, তরুণ সমাজ এবং নতুন প্রজন্মের কাছে অনুরোধ, তোমরা তোমাদের পূর্বসূরীদের আত্মোৎসর্গের কথা কখনই ভুলে যেও না। তাদের উপহার দেওয়া লাল-সবুজ পতাকার অসম্মান হতে দিও না।
তরুণ প্রজন্মকে উদ্দেশ্য করে শেখ হাসিনা বলেন, যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে তোমরা তোমাদের পূর্বপুরুষদের বিজয়-নিশান সমুন্নত রাখার শপথ নাও এই বিজয় দিবসে। প্রতিজ্ঞা কর, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এদেশকে সোনার বাংলাদেশে পরিণত করবে। তবেই ৩০ লাখ শহিদের আত্মা শান্তি পাবে। জাতির পিতার স্বপ্ন পূরণ হবে।