আগামী জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরি করোনাভাইরাসের টিকার প্রথম চালান বাংলাদেশে আসবে বলে আশা করছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীতে হাম-রুবেলা টিকাদান কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী এ কথা জানান। তিনি বলেন, আমরা আশা করি, আগামী মাসের প্রথম দিকেই প্রথম কোয়ার্টারেই আমরা টিকা পেয়ে যাব। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে বাংলাদেশে আনার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তিন কোটি ডোজ টিকা সরকার নিয়ে আসছে সরাসরি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ টিকার এই ব্যবস্থা করতে পেরেছে মন্তব্য করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ডব্লিউএইচও আমাদের টিকা দেবে আমাদের জনসংখ্যার বিশ শতাংশ হারে। সেটা আসতে হয়ত কিছুটা সময় লাগবে। কিন্তু আমরা টিকা পাব। অনেক দেশ আছে, যারা এখনও টিকার ব্যবস্থা করতে পারেনি। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও অ্যাস্ট্রাজেনেকা করোনাভাইরাসের যে টিকা তৈরি করছে, তার তিন কোটি ডোজ কিনতে সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে চুক্তি করেছে সরকার।
করোনাভাইরাসের কোনো কার্যকর ওষুধ না থাকায় পুরো বিশ্ব এখন তাকিয়ে আছে টিকার দিকে। ভ্যাকসিন কেনার জন্য ১৬ নভেম্বর স্বাস্থ্যসেবা বিভাগকে ৭৩৫ কোটি ৭৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দিয়ে রেখেছে অর্থ বিভাগ।
সরকারিভাবে প্রথম দফায় করোনাভাইরাসের তিন কোটি ডোজ টিকা এনে তা এই মহামারি মোকাবিলায় যারা সামনে থেকে কাজ করছেন তাদের বিনামূল্যে বিতরণ করা হবে। করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলা ও ভ্যাকসিন সংগ্রহের সর্বশেষ অগ্রগতি সম্পর্কে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম এসব তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনের তিন কোটি ডোজ সংগ্রহের প্রস্তাবে গত ১৪ অক্টোবর অনুমোদন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর গত ৫ নভেম্বর সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া এবং বাংলাদেশের বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের সঙ্গে সরকার চুক্তিও করেছে। প্রথম দফায় ভ্যাকসিন কারা পাবে- সেই প্রশ্নে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটা গাইডলাইন আছে। প্রথম কারা পাবে, দ্বিতীয় ধাপে কারা পাবে, সে অনুযায়ী তারা একটা প্রোগ্রাম ডেভেলপ করছে। ফ্রন্টলাইন ওয়ার্কার- পুলিশ, প্রশাসনের লোক যারা মাঠে চাকরি করছে, তারপর বয়স্ক লোক, বাচ্চা- এরকম একটা প্রোটোকল আছে। সচিব বলেন, মানুষকে এই ভ্যাকসিন বিনা পয়সায় দেওয়া হবে। টাকা সরকার পে করে দিচ্ছে। তিন কোটি ভ্যাকসিন ফ্রি দেওয়া হবে। এই টিকা বিতরণে অনিয়ম হলে কী হবে- এমন প্রশ্নে আনোয়ারুল বলেন, করাপশন কেউ করলে আমাদেরকে জানাবেন, উই উইল টেইক অ্যাকশন। মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান, এই ভ্যাকসিন কিনতে মোট কত টাকা করে খরচ হবে তা ক্রয়চুক্তি না হওয়া পর্যন্ত বলা যাচ্ছে না।
তবে এখনই বলা যাচ্ছে না কোনটা বেশি কার্যকর হবে। আমাদের এক নম্বর কন্ডিশন হল, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রটোকল মানতে হবে। যার সাথে চুক্তি করবেন, যদি মেজর কোনো সমস্যা হয়, তাহলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রটোকলের বাইরে গেলে ওই চুক্তির কোনো মূল্য থাকবে না। বাংলাদেশে চীনা কোম্পানি সিনোভ্যাকের সম্ভাব্য টিকার ট্রায়াল আটকে থাকার বিষয়ে এক প্রশ্নে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ওরা একটা টাকা চাচ্ছে। সরকার এখনও দেয়নি বা রাজি হয়নি। আমরা ওটা এখনও বাতিলও করিনি।
করোনা ভ্যাকসিন কিনতে প্রথম ধাপে ৭৩৫ কোটি টাকা বরাদ্দ:
যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের তৈরি টিকার পরিবহন ব্যয়সহ প্রতি ডোজের মূল্য নির্ধারণ করা হয় পাঁচ মার্কিন ডলার। ভ্যাকসিনের আনুষঙ্গিক উপকরণের জন্য ব্যয় এক দশমিক ২৫ ডলার ধার্য করা হয়। এতে প্রতি ডোজ ভ্যাকসিন বাবদ মোট খরচ দাঁড়ায় ছয় ডলার ২৫ সেন্ট। প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলাদেশের নেওয়া তিন কোটি ডোজ ভ্যাকসিনের মোট মূল্য দাঁড়ায় এক হাজার ৫৮৯ কোটি ৪৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা।
সরকারিভাবে এই ভ্যাকসিন ক্রয়, পরিবহনসহ আনুষঙ্গিক ব্যয় হিসাবে উল্লিখিত অংকের টাকা বরাদ্দ চায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তাদের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ৭৩৫ কোটি ৭৬ লাখ ৮২ হাজার টাকা বরাদ্দ দিয়েছে অর্থ বিভাগ। যার মধ্যে ভ্যাকসিন কিনতে ৬৩৫ কোটি ৭৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং আনুষঙ্গিক খরচ হিসাবে বাকি ৯৯ কোটি ৯৯ লাখ ৩২ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চাহিদাপত্র পাওয়ার পর গত ৩০ নভেম্বর স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. আবদুল মান্নান ভ্যাকসিন কেনার বিষয়ে অর্থনৈতিক বিষয়ক সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির কাছে সারসংক্ষেপ পাঠান। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর অনুমতি সাপেক্ষে পাঠানো এ সারসংক্ষেপে করোনা ভ্যাকসিন কিনতে সরকারের ব্যয় ও ডোজপ্রতি ভ্যাকসিনের ব্যয় উল্লেখ করা হয়।
পরে গত ২ ডিসেম্বর রাষ্ট্রীয় জরুরি প্রয়োজনে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতি অনুসরণ করে করোনা ভ্যাকসিন কিনতে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের প্রস্তাবের নীতিগত অনুমোদন দেয় অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। এরপর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রস্তাবিত বরাদ্দ থেকে প্রথম ধাপে অর্ধেক বরাদ্দ দেয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়।
এরপর অর্থ বিভাগ (বাজেট অনুবিভাগ-১) থেকে অর্থ বরাদ্দের মঞ্জুরি আদেশ জারি করা হয়। এতে বলা হয়, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে কোভিড-১৯ প্রতিরোধক ভ্যাকসিন ক্রয়ের লক্ষ্যে পরিবহন খরচসহ কোল্ড চেইনে পৌঁছানো পর্যন্ত তিন কোটি ডোজ ভ্যাকসিন কিনতে (ওষুধ ও প্রতিষেধক বাবদ) এক হাজার ২৭১ কোটি ৫৫ লাখ টাকার ৫০ শতাংশ অর্থাৎ ৬৩৫ কোটি ৭৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং কোল্ড চেইন ইকুয়েপমেন্ট, এডি সাইরিংগস বক্সেস ক্রয়, ভ্যাকসিন কেন্দ্র পর্যন্ত পরিবহন, জনবল, মাইক্রোপ্লানিং ও তালিকা প্রণয়ন, সুপারিশ ও মনিটরিং, প্রশিক্ষণ, প্রচার-প্রচারণাসহ মানুষের শরীরে ভ্যাকসিন দেয়া পর্যন্ত খরচ হিসাবে প্রায় ১০০ কোটি টাকাসহ মোট ৭৩৫ কোটি ৭৬ লাখ ৮২ হাজার টাকা চলতি (২০২০-২১) অর্থবছর অর্থ বিভাগের বাজেটে ‘করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় তহবিল’ থেকে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অনুকূলে প্রদানের মঞ্জুরি আদেশ নির্দেশক্রমে জারি করা হলো।
অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে কয়েকটি শর্ত দেওয়া হয়েছে। শর্তগুলো হলো- ভ্যাকসিন ক্রয়ের ক্ষেত্রে সরকারি অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদন নিতে হবে; সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত কমিটির অনুমোদন গ্রহণ করতে হবে; অর্থ বিভাগের মতামত গ্রহণপূর্বক ব্যাংক গ্যারান্টি চূড়ান্ত করতে হবে; অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে দ্য পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অ্যাক্ট-২০০৬ এবং দ্য পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস-২০০৮ অনুসরণসহ যাবতীয় আর্থিক বিধি-বিধান যথাযথভাবে পালন করতে হবে এবং ভ্যাকসিন ক্রয় ও কোল্ড চেইন ইকুয়েপমেন্ট, এডি সাইরিংগস বক্সেস ক্রয় বাবদ ব্যয় সম্পাদনের এক মাসের মধ্যে ব্যয় করা অর্থের সাপেক্ষে যথাযথ কর্তৃপক্ষের প্রত্যয়নসহ বিল-ভাউচার ও ব্যয় প্রতিবেদন অর্থ বিভাগে পাঠাতে হবে।
প্রথম ধাপে খাতভিত্তিক বরাদ্দ:
প্রথম ধাপে তিন কোটি ডোজ টিকা জনগণের মাঝে বিনামূল্যে বিতরণের জন্য ইতোমধ্যে অর্ধেক টাকা বরাদ্দ দিয়েছে অর্থ বিভাগ। বিভিন্ন খাতে এ অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। প্রথম ধাপে স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রস্তাবিত করোনা ভ্যাকসিনের ডোজ (ওষুধ ও প্রতিষেধক) বাবদ এক হাজার ২৭১ কোটি ৫৫ লাখ টাকার বিপরীতে ৬৩৫ কোটি ৭৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। আপ্যায়ন ব্যয়ের জন্য প্রস্তাবিত ৮৯ কোটি ৮৫ লাখ ৬০ হাজার টাকার পরিপ্রেক্ষিতে কোনো টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়নি। প্রস্তাবিত হায়ারিং চার্জ ছয় লাখ ৮০ হাজার টাকার পুরোটাই বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
প্রচার ও বিজ্ঞাপন ব্যয়ের জন্য প্রস্তাবিত ১৪ কোটি ১৭ লাখ ৩৮ হাজার টাকার পরিপ্রেক্ষিতে কোনো টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়নি। ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের জন্য প্রস্তাবিত এক কোটি দুই লাখ টাকার পরিপ্রেক্ষিতেও কোনো টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়নি। ভ্রমণ ব্যয়ের জন্য প্রস্তাবিত ছয় কোটি ৭৬ লাখ ১৯ হাজার টাকার পরিপ্রেক্ষিতেও কোনো বরাদ্দ হয়নি। বরাদ্দ হয়নি স্বাস্থ্য বিধান সামগ্রীর জন্য প্রস্তাবিত তিন কোটি ৩৮ লাখ ৬৪ হাজার টাকাও।
পণ্যের ভাড়া ও পরিবহন ব্যয়ের প্রস্তাবিত ৯৩ কোটি ৩০ লাখ ৯৮ হাজার টাকার মধ্যে আট কোটি ৯৮ লাখ ৪৪ হাজার টাকা, প্রশিক্ষণ ব্যয়ের জন্য প্রস্তাবিত ১৫ কোটি ১৬ লাখ ৬৮ হাজার টাকার মধ্যে ১২ কোটি ৮০ লাখ ৩৭ হাজার টাকা, চিকিৎসা ও শল্য চিকিৎসা সরঞ্জামাদি বাবদ প্রস্তাবিত ৫৮ কোটি ৫৩ লাখ ৫৩ হাজার টাকার বিপরীতে ৫৬ কোটি ৫৩ লাখ ৮৮ হাজার টাকা, মুদ্রণ ও বাঁধাইয়ের জন্য প্রস্তাবিত ছয় কোটি ২৬ লাখ এক হাজার টাকার পুরোটাই বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
এছাড়া জরিপের জন্য প্রস্তাবিত ৯৫ লাখ টাকার বিপরীতে কোনো টাকাই বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। সম্মানী বাবদ প্রস্তাবিত ১০ কোটি চার লাখ ৭৬ হাজার টাকার মধ্যে তিন কোটি ৯৯ লাখ ১৮ হাজার টাকা, প্রকৌশলী এবং অন্যান্য সরঞ্জামাদি বাবদ প্রস্তাবিত ১৩ কোটি ৬৪ লাখ ৭০ হাজার টাকার পুরোটাই বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বরাদ্দ হয়েছে ডাটাবেজ বাবদ প্রস্তাবিত তিন কোটি ৬৯ লাখ ৯৪ হাজার টাকার পুরোটাই। তবে চিকিৎসা ব্যয় বাবদ প্রস্তাবিত ২১ লাখ ৫৪ হাজার টাকার বিপরীতে কোনো টাকাই বরাদ্দ দেয়া হয়নি।
ভ্যাকসিন কিনতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দের বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) অধ্যাপক আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, ‘করোনার ভ্যাকসিন কিনতে আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে এক হাজার ৫৮৯ কোটি ৪৪ লাখ টাকা বরাদ্দ চেয়েছিলাম। এরই প্রেক্ষিতে ইতোমধ্যে অর্থ বিভাগ থেকে আমাদের প্রস্তাবের অর্ধেক টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এটি প্রথম ধাপের টাকা। পরে বাকি টাকা দেওয়া হবে। এখন আমাদের কাজ শুরু করার জন্যই প্রথম ধাপের এই বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এটি দিয়ে আমরা কাজ শুরু করব