বুধবার ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে বাংলাদেশ বিনিয়োগ সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে বক্তৃতা দেন ড. ইউনূস। সেখানে তিনি উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীদের শোনান নোবেলজয়ী প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংক এবং দেশের শীর্ষ মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণফোন প্রতিষ্ঠার কাহিনী।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ”টাকা উপার্জন করা সুখ, কিন্তু অন্যদের সুখী করা হল সুপার সুখ। যদি আপনি বাংলাদেশে ব্যবসা করেন, তাহলে আপনি দুটি সুখই পাবেন—সাধারণ সুখ এবং সুপার সুখ। এবং এটি আপনি অতিরিক্ত কিছু খরচ ছাড়াই পেয়ে যাবেন।”
তিনি ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের কথা স্মরণ করে বলেন, “৭৪ সাল সেই বছর, যা আমরা ভুলতে পারব না। মানুষ ক্ষুধার কারণে মৃত্যুবরণ করে। পুরো দেশজুড়ে দুর্ভিক্ষ বয়ে যায়। দেড় মিলিয়ন মানুষ মারা যায়। ওটাই ছিল সেই দেশ, যেখান থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল।”
“আমরা এক ফসলই ফলাতাম। আর কোনো উপায় আমাদের জানা ছিল না। আমাদের জনসংখ্যা ছিল কৃষক হিসেবেই পরিচিত, কারণ তাদের আর কোনো পেশা ছিল না। তাদের মধ্যে ছিল ভূমিহীন কৃষক। তাদের নিজের কোনো জমি ছিল না। যারা অল্প জমির মালিক ছিল, তাদের কাছ থেকে সামান্য জমি লিজ নিয়ে এক ফসল ফলিয়ে জীবিকা চলত। আপনি যদি ‘চরম দারিদ্র্য’ শব্দটা শুনে থাকেন—সেটাই ছিল বাংলাদেশ। জীবনটা ছিল খুব কঠিন।”
প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, “আমরা আমাদের যাত্রা শুরু করি ১৯৭৪ থেকে ২০২৫ পর্যন্ত—এটা এক অসাধারণ ভ্রমণ। এখানে আমরা সব বড় শিল্প নিয়ে কথা বলি। অনেক দেশকে আমন্ত্রণ জানাই আরও শিল্প স্থাপনের জন্য। আমরা একটি বিশাল বাজার নিয়ে কথা বলি।”
গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “সেই দুর্ভিক্ষপীড়িত দেশে একটি ছোট উদ্যোগ এসেছে কিছুটা স্বস্তি নিয়ে। মানুষকে ২ বা ৩ ডলারের মত ছোট ঋণ দেওয়া হত, যেন তারা ছোট ব্যবসা শুরু করতে পারে—বিশেষভাবে নারীদের ওপর গুরুত্ব দিয়ে। এই ধারণা ‘মাইক্রো ক্রেডিট’ নামে পরিচিত হয়।”
“আমরা একটি ব্যাংক তৈরি করি, যার নাম গ্রামীণ ব্যাংক। কেউ জানত না শেষ পর্যন্ত এটি কোথায় গিয়ে পৌঁছাবে। কিন্তু এটি হয়ে উঠল একটি বৈশ্বিক নাম।”
তিনি আরও বলেন, “গরিব মানুষকে শুধু সরকারি টাকা দেওয়াটা কোনো সমাধান নয়। আসল সমাধান হল একটি কাঠামো তৈরি করা, যা মানুষের শক্তিকে মুক্ত করে দেয়। মাইক্রোক্রেডিট ছিল সেই উদ্যোগের একটি ক্ষুদ্র উদাহরণ।”
গ্রামীণফোন প্রতিষ্ঠার অভিজ্ঞতা স্মরণ করে ইউনূস বলেন, “এক পাগলাটে চিন্তা এল—সরকার ফোন ব্যবহারের লাইসেন্স দেবে। তখন আমাদের কোনো ফোনই ছিল না, টেলিফোন বলতে দেশে কিছুই ছিল না।”
“আমি বললাম—আমি এটা গরিব মহিলাদের হাতে তুলে দেব। তারা আমাদের নিয়ে হাসাহাসি করল। কিন্তু আমরা শেষমেশ লাইসেন্স পেয়ে যাই। নাম দিই ‘গ্রামীণফোন’। কেউ আমাদের সঙ্গে অংশীদার হতে চাইল না, কারণ আমাদের কোনো জ্ঞান ছিল না, কিছুই জানতাম না।”
তিনি আরও বলেন, “যদিও সবাই বলেছিল, বাংলাদেশ মোবাইল ফোনের জন্য উপযুক্ত জায়গা না। কিন্তু নরওয়ের টেলিনর কোম্পানি আমাদের পাশে দাঁড়ায়। তারা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেয় এবং পরবর্তীতে এটি দেশের সর্ববৃহৎ টেলিফোন কোম্পানি হয়ে ওঠে।”
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “আজ যারা পুরস্কৃত হয়েছেন, তাদের শক্তিশালী পাগলাটে ধারণাই তাদের সফল করেছে। তাই আমি আপনাদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি সেই সৃষ্টি কাজে যোগ দিতে—শুধু বাংলাদেশকেই পরিবর্তন করবেন না, ব্যবসার মাধ্যমে পৃথিবীকে বদলান।”
তিনি বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশ্যে বলেন, “আপনি জানবেন না আপনার ব্যবসা কেমন হবে, কেন পুরো পৃথিবী আপনাকে অনুসরণ করছে, হঠাৎ করে পিছনে ফিরে তাকাবেন, কীভাবে এটা ঘটল—বাংলাদেশ এটা সম্ভব করেছে।”
তিনি আরও বলেন, “এটি একটি শক্তিশালী অঞ্চল, অনেক সম্পদ রয়েছে, আমরা একসাথে এটি সহজতর করতে পারি।”
তিন শূন্যের ধারণা নিয়ে যে পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন ইউনূস দেখেন, তা কেবল সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব বলে মন্তব্য করেন তিনি।
“এটি সরকারের কাজ নয়, একক ব্যক্তির কাজ। আমরা মনুষ্যজাতি, পৃথিবী বদলাতে পারি। ব্যবসা আমাদের হাতে একটি শক্তিশালী ‘টুল’ তুলে দিয়েছে,” বলেন ইউনূস।
দেশের পোশাক শিল্পের শুরুর দিকের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “৭০-এর দশকের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা কিছু সাহসী তরুণ, যারা অন্যরকম কিছু করার সাহস দেখিয়েছিল। বিদেশি দেশগুলোর গার্মেন্ট শিল্প দেখে তারা বলেছিল, ‘কেন আমাদের না?'”
তিনি বলেন, “এটি ছিল বাংলাদেশে গার্মেন্ট শিল্পের সূচনা। সেই পাগল তরুণরা, তারা ছিল প্রথম প্রজন্ম, তাদের মধ্যে কিছু এখনও এখানেও উপস্থিত আছেন। এখন আমরা দ্বিতীয় প্রজন্মে প্রবেশ করছি। দ্বিতীয় প্রজন্মের উদ্যোক্তারা আমাদের শক্তি।”
ইউনূস বলেন, “এটি ছিল প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের একটি যাত্রা, এখন দেশের তৃতীয় প্রজন্ম উঠে আসছে, আমরা কি প্রস্তুত? এগুলো আমাদের চ্যালেঞ্জ।”
নারীদের উদ্যোক্তা হিসেবে সৃজনশীলতার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “তরুণ প্রজন্ম পৃথিবী পরিবর্তন করবে, তাদের কাছে রয়েছে প্রযুক্তি, সৃজনশীলতা, উদ্ভাবন এবং সমস্যা সমাধানের উদ্ভাবনী ধারণা।”
“বাংলাদেশে ব্যবসা শুধুমাত্র বাংলাদেশের জন্য নয়, এটি পুরো বিশ্বের জন্য হতে পারে,” তিনি যোগ করেন।
গ্রামীণ আমেরিকার মত সফল উদ্যোগের কথা তুলে ধরে ইউনূস বলেন, “কে ভেবেছিল, এক ছোট্ট গ্রাম থেকে জন্ম নেয়া ক্ষুদ্র ঋণ একসময় যুক্তরাষ্ট্রে প্রাইম ব্যবসা গ্রামীণ আমেরিকা হবে।”
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের আয়োজনে ৭ এপ্রিল শুরু হওয়া এই সম্মেলনে বিশ্বের শীর্ষ ব্যবসায়ী নির্বাহী এবং নীতিনির্ধারকেরা অংশগ্রহণ করেছেন।