গত সেপ্টেম্বরে যুক্তরাজ্যে করোনাভাইরাসের ‘অত্যন্ত সংক্রামক’ ওই নতুন ধরনটির সন্ধান মেলে, যা এখন লন্ডনসহ ইংল্যান্ডের বেশ কিছু এলাকায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। ভাইরাসের ওই ভ্যারিয়েন্ট ইতোমধ্যে অস্ট্রেলিয়া ও নেদারল্যান্ডসেও পেঁছে গেছে। এই পরিস্থিতিতে ইউরোপীয় প্রতিবেশীসহ ৪০টির বেশি দেশ যুক্তরাজ্যের নাগরিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে; বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ ভারতও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে ফ্লাইট বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ এখনও সেরকম কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে গতকাল সচিবালয়ে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. মহিবুল হক সাংবাদিকদের বলেন, আমরা বিষয়টির উপর তীক্ষ্ম নজর রাখছি, সময় মত সিদ্ধান্তটা সবাইকে জানিয়ে দেব। আমরা বিষয়টি পর্যবেক্ষণ যেমন করছি, পর্যালোচনাও করছি। আমরা আমাদের সিদ্ধান্তটা খুব দ্রুত জানাব। বাংলাদেশ এখনও কোনো দেশের সঙ্গে ফ্লাইট পরিচালনা বন্ধ করেনি জানিয়ে তিনি বলেন, কিছু দেশ যেহেতু আমাদের এক্সেস দিচ্ছে না, সে কারণে আমাদের বিমান যেতে পারছে না। আমরা মধ্যপ্রাচ্যে (ফ্লাইট) বন্ধ করিনি, তারা তাদেরটা বন্ধ করেছে বলে আমাদের বিমান যেতে পারছে না। সৌদি আরব আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধ করে দেওয়ায় বাংলাদেশি যাত্রীদের ভোগান্তি নিয়ে এক প্রশ্নে মহিবুল বলেন, বিভিন্ন দেশে যে সমস্ত ফ্লাইটগুলো বন্ধ হয়েছে, যাত্রীদের ভোগান্তি হয়েছে, আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত। কারণ এটা তো আমাদের এখতিয়ার বহির্ভূত। আমরা যেটা করতে পারি, তাদের কোনো রকম ফি ছাড়াই, যখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, আমরা এই টিকিটটা রি-ইস্যু করে দেব তাদের। তখন তারা কোনো রকম বাড়তি পয়সা ছাড়াই আবার যেতে পারবে। অতীতের মত যাত্রীদের জন্য বাংলাদেশ বিমানের এ ধরনের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে বলে সবাইকে আশ্বস্ত করেন বিমান সচিব।
দুই হাজার কোটি টাকার ক্ষতিঃ করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে বিমানের তিন হাজার কোটি টাকা এবং পর্যটন খাতে দুই হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে জানিয়ে মো. মহিবুল হক বলেন, সারা পৃথিবীর মত বাংলাদেশেও করোনা পরিস্থিতির জন্য অনেক খাতে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে। একক মন্ত্রণালয় হিসেবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে আমাদের বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের। আমাদের বিমান, এয়ারপোর্ট, পর্যটন, হোটেল, মোটেল, রিসোর্টসহ সকল কিছু মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনি আরো বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের কারণে আমরা ধীরে ধীরে একটা পর্যায়ে চলে আসছিলাম। আমাদের বিমানবন্দর, হোটেল-মোটেল, রিসোর্টগুলো খুলে দিয়েছি। সোমবার পর্যন্ত বাংলাদেশে ২৯টি এয়ারলাইন্স ফ্লাইট পরিচালনা করছিল জানিয়ে তিনি বলেন, এর মধ্যে যাত্রীবাহী ফ্লাইটের সংখ্যা ছিলো ১৯৮টি, আর কার্গোবাহী ফ্লাইট ছিল ৭৪টি।
যুক্তরাজ্যের সঙ্গে ভারতে ফ্লাইট বন্ধঃ যুক্তরাজ্যে করোনাভাইরাসের অতি সংক্রামক নতুন ‘রূপ’ এর প্রাদুর্ভাবে কারণে দেশটিতে ফ্লাইট আপাতত বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত। ভারত আপাতত ২৩-৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের সঙ্গে বিমান চলাচল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যুক্তরাজ্য ভ্রমণেও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। ৩১ ডিসেম্বর রাত প্রায় ১২ টা পর্যন্ত যুক্তরাজ্য থেকে কোনও বিমান ভারতে প্রবেশ করতে পারবে না। আবার ভারত থেকেও কোনও বিমান যুক্তরাজ্যে যাবে না।
ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকা জানিয়েছে, যুক্তরাজ্যে করোনাভাইরাসের নতুন স্ট্রেইনের প্রাদুর্ভাব হওয়ার পর থেকেই বিষয়টি নিয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছিল। পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনায় যুক্তরাজ্যের সঙ্গে আপাতত বিমান চলাচল বন্ধ করতে কেন্দ্রের কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী। এরপরই গত সোমবার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়েছে বিমান পরিষেবা মন্ত্রণালয়। গতকাল রাত ১১টা ৫০ মিনিট থেকে এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়েছে। তার আগ পর্যন্ত যুক্তরাজ্য থেকে ভারতে পৌঁছানো যাত্রীদের বিমানবন্দরে বাধ্যতামূলকভাবে আরটিপিসিআর পরীক্ষা করতে হবে।
ইউরোপের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের যোগাযোগ বিচ্ছিন্নঃ গত শনিবার যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ও বিজ্ঞানীরা দেশটিতে করোনাভাইরাসের একটি নতুন রূপ শনাক্তের কথা ঘোষণা করে এ ধরনটি ৭০ শতাংশ বেশি সংক্রামক বলে জানান। এরপরই গোটা বিশ্বে নতুন করে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ায় যুক্তরাজ্যের সঙ্গে এরই মধ্যে সাময়িকভাবে বিমান চলাচল বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, ইতালিসহ ইউরোপের একাধিক দেশ। তাছাড়া, করোনাভাইরাসের নতুন ধরনটি কেবল যুক্তরাজ্যেই নয় আরো কয়েকটি দেশেও দেখা গেছে। এ মাসের শুরুতে নেদারল্যান্ডসে পরীক্ষায় ঠিক একই ধরনের ভাইরাসের স্ট্রেইন পাওয়া গেছে। অস্ট্রেলিয়াও গত সোমবার করোনাভাইরাসের অতি-সংক্রামক নতুন ধরনের প্রাদুর্ভাবের কথা জানিয়েছে। যুক্তরাজ্য থেকে অস্ট্রেলিয়ায় যাওয়া দুইজনের দেহে এ ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। ইতালিতেও করোনাভাইরাসের একইরকম নতুন ধরন দেখা গেছে।
বার্তা সংস্থার রয়টার্স জানিয়েছে, যুক্তরাজ্য করোনাভাইরাসের নতুন একটি ধরন শনাক্তের কথা ঘোষণার পর দেশটি থেকে ফ্লাইট চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, জার্মানি ও ইতালি। রবিবার রাত থেকে পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টার জন্য যুক্তরাজ্য থেকে আসা সবার প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ফ্রান্স। সড়ক, সমুদ্র, রেল ও আকাশপথে মালামাল বহন করে নিয়ে আসা লোকজনও এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়বে বলে দেশটি জানিয়েছে। আয়ারল্যান্ড জানিয়েছে, রবিবার মধ্যরাত থেকেই তারা প্রতিবেশী দেশটির ফ্লাইট এবং ফেরি চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। প্রাথমিকভাবে ৪৮ ঘন্টা এই বিধিনিষেধ জারি রাখা হবে বলে জানিয়েছে তারা। বেলজিয়াম জানিয়েছে, তারাও রবিবার মধ্যরাত থেকে যুক্তরাজ্য থেকে আসা জনপ্রিয় ইউরোস্টার সার্ভিসসহ ট্রেন, ফ্লাইটের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী আলেকজান্দ্রার দো কো টিভি চ্যানেল ভিআরটিতে বলেছেন, পূর্বসতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে এই নিষেধাজ্ঞা অন্তত ২৪ ঘন্টা পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। আরো কোনও পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন কিনা সেটি আমরা পরে দেখবো।
ইতালির স্বাস্থ্যমন্ত্রী রোবের্তো স্পেরানজা বলেছেন, সম্প্রতি লন্ডনে আবিষ্কৃত কোভিডের ধরনটি উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো। আমাদের বিজ্ঞানীদেরও এটি পরীক্ষা করে দেখা দরকার। এর মধ্যে আমরা সবচেয়ে বিচক্ষণ পথটি বেছে নিয়েছি। ইতালি যুক্তরাজ্য থেকে ছেড়ে আসা সব ধরনের ফ্লাইটে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এর পাশাপাশি গত ১৪ দিনের মধ্যে ব্রিটেন ঘুরে আসা সবার ইতালি প্রবেশেও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দেশটি।
জার্মানির স্বাস্থ্যমন্ত্রী ইয়েনস্ ইসপান সরকারি গণমাধ্যম এআরডিকে বলেছেন, এটি (ভাইরাসের এই মিউটেশনটি) এখনও জার্মানিতে পাওয়া যায়নি, কিন্তু অবশ্যই ব্রিটেন থেকে আসা প্রতিবেদনগুলোকে আমরা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছি।
জার্মানির স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সরকার দক্ষিণ আফ্রিকা থেকেও ফ্লাইট নিষিদ্ধ করার কথা ভাবছে। জার্মান সরকার যুক্তরাজ্যের পরিস্থিতি নজরে রেখেছে এবং খুবই চাপের মধ্যে থেকে সেখানকার নতুন ধরনের করোনাভাইরাস সম্পর্কিত তথ্য মূল্যায়ন করে দেখছে।
বেলজিয়ামে কেবল যুক্তরাজ্যের ফ্লাইটই নয় ট্রেন চলাচলও নিষিদ্ধ করেছে। জার্মানি এবং ফ্রান্সও একইরকম পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ভাবছে। আয়ারল্যান্ড রবিবার মধ্যরাত থেকেই যুক্তরাজ্যের ফ্লাইট এবং ফেরি চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। প্রাথমিকভাবে ৪৮ ঘন্টা এই বিধিনিষেধ জারি রাখা হবে বলে জানিয়েছে বিবিসি।
ফ্রান্সের নিউজ চ্যানেল বিএফএমটিভিও জানিয়েছে, ফরাসি সরকার খুবই গুরুত্বের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে ফ্লাইট এবং ট্রেন চলাচল নিষিদ্ধ করার কথা ভাবছে। এ ব্যাপারে শিগগিরই ঘোষণা দেওয়া হবে। সুইডেন জানিয়েছে, যুক্তরাজ্য থেকে তাদের দেশে প্রবেশের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপের সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা। রোমানিয়া, লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া, এস্তোনিয়া, বুলগেরিয়া ও চেক রিপাবলিকও যুক্তরাজ্যের ফ্লাইটের ওপর নিষেধাজ্ঞার পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে।