ঢাকা ০৫:৪৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ২১ এপ্রিল ২০২৫, ৮ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

শিক্ষার শেষ পরিণতি কি রিক্সার প্যাডেল ?

মাহবুব পিয়াল,ফরিদপুর : ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের এক সময়কার মেধাবী ছাত্র জুলহাস ব্যাপারী। ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষে তিনি ব্যবস্থাপনা বিভাগে ভর্তি হন, মাস্টার্স শেষ করেন ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে। অনার্স আর মাস্টার্সের সনদ হাতে নিয়ে যখন সুন্দর ক্যারিয়ারের স্বপ্ন বুনছিল, তখন হয়তো কল্পনাও করতে পারেনি একদিন তার জীবনযাত্রার একমাত্র অবলম্বন হয়ে উঠবে রিকশার হ্যান্ডেল। সেই উচ্চশিক্ষিত তরুণ, যে একসময় পড়াশোনার খরচ চালাতে রং মিস্ত্রির কাজ করত, আজ জীবিকার তাগিদে রিকশা চালাচ্ছেন। এই সমাজ, যে সমাজে উচ্চশিক্ষাকে বলা হয় ভবিষ্যতের চাবিকাঠি, সেখানে জুলহাসের আজকের অবস্থান আমাদের সমাজের নির্মম পরিহাস।


ফরিদপুরের ভাজনডাঙ্গায় এক জীর্ণশীর্ণ কোয়াটারের ছোট্ট এক ঘরে স্ত্রী, মেয়ে ও বৃদ্ধ বাবা মা নিয়ে বসবাস করেন জুলহাস। জুলহাসের জীবন কখনো সহজ ছিল না। একসময় রং মিস্ত্রি হিসেবে কাজ করতেন, তবে ভালো একটা চাকরির আশায় পড়াশোনা চালিয়ে যান। ব্যবস্থাপনা বিভাগে পড়াশোনা শেষ করার পর তাঁর স্বপ্ন ছিল কোনো কর্পোরেট অফিসে চাকরি করবেন, হয়তো ব্যাংকে বা সরকারি দপ্তরে স্থান পাবেন। কিন্তু বাস্তবতা ছিল অন্যরকম।
অসংখ্য চাকরির আবেদন করেছেন, পরীক্ষা দিয়েছেন, ইন্টারভিউতে অংশ নিয়েছেন। কিন্তু ভাগ্য তার জন্য কোনো দরজা খোলেনি। কোথাও বলা হয়েছে”অভিজ্ঞতার অভাব”, কোথাও শুনেছেন” সুপারিশ বা তদবির লাগবে”। টাকা দিয়ে চাকরি করার ক্ষমতা ছিল না, রাজনৈতিক ছত্রছায়াও ছিল না, তাই বারবার ব্যর্থ হয়েছেন।
দিনের পর দিন চেষ্টা করেও চাকরির দরজা না খুলতে দেখে একসময় হাল ছেড়ে দেন। সংসারের অভাব ক্রমেই বাড়তে থাকে। বাবা-মা বৃদ্ধ, কাজ করতে পারেন না। স্ত্রী সংসার, আর তৃতীয় শ্রেণিতে পড়া ছোট্ট মেয়ে জোবাইদার পড়াশোনা । সবকিছুই তার সামান্য উপার্জনের ওপর নির্ভরশীল। বাধ্য হয়ে জীবনের এই কঠিন বাস্তবতা মেনে নিয়েছেন।
“আমি পড়াশোনা করেছি, একটা ভালো চাকরির স্বপ্ন দেখেছি। কিন্তু এখন আমার পরিচয় কী? আমি একজন রিকশাচালক। সমাজে আমার কোনো সম্মান নেই, কেউ আমাকে গুরুত্ব দেয় না,”কথাগুলো বলার সময় তার চোখে জল জমে যায়। তাঁর নয় বছর বয়সী একমাত্র মেয়ে জোবাইদা, যার ছোট্ট দুটি চোখে বাবার জন্য গর্ব থাকার কথা, সেখানে আজ শুধুই হতাশার ছায়া।
জুলহাসের জীবনের গল্প শুধু তার একার নয়, হাজারো মেধাবী তরুণের গল্প, যারা সিস্টেমের ব্যর্থতার কারণে হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা কি পারি না এই মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াতে? এই সমাজ কি শুধু উচ্চবিত্তদের জন্য? শুধু সুপারিশ আর টাকার জোরেই কি চাকরি পাওয়া যাবে? তাহলে জুলহাসদের মতো মেধাবী, পরিশ্রমী তরুণদের কী হবে? প্রশ্ন রইল সমাজের উচ্চবিত্তদের কাছে! আর্থিক সাহায্য নয়, যোগ্যতা অনুযায়ী ভালো একটি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাই পারে জুলহাস এর জীবনে আলো ফেরাতে!

Tag :

শিক্ষার শেষ পরিণতি কি রিক্সার প্যাডেল ?

Update Time : ১২:২০:২১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৮ এপ্রিল ২০২৫

মাহবুব পিয়াল,ফরিদপুর : ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের এক সময়কার মেধাবী ছাত্র জুলহাস ব্যাপারী। ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষে তিনি ব্যবস্থাপনা বিভাগে ভর্তি হন, মাস্টার্স শেষ করেন ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে। অনার্স আর মাস্টার্সের সনদ হাতে নিয়ে যখন সুন্দর ক্যারিয়ারের স্বপ্ন বুনছিল, তখন হয়তো কল্পনাও করতে পারেনি একদিন তার জীবনযাত্রার একমাত্র অবলম্বন হয়ে উঠবে রিকশার হ্যান্ডেল। সেই উচ্চশিক্ষিত তরুণ, যে একসময় পড়াশোনার খরচ চালাতে রং মিস্ত্রির কাজ করত, আজ জীবিকার তাগিদে রিকশা চালাচ্ছেন। এই সমাজ, যে সমাজে উচ্চশিক্ষাকে বলা হয় ভবিষ্যতের চাবিকাঠি, সেখানে জুলহাসের আজকের অবস্থান আমাদের সমাজের নির্মম পরিহাস।


ফরিদপুরের ভাজনডাঙ্গায় এক জীর্ণশীর্ণ কোয়াটারের ছোট্ট এক ঘরে স্ত্রী, মেয়ে ও বৃদ্ধ বাবা মা নিয়ে বসবাস করেন জুলহাস। জুলহাসের জীবন কখনো সহজ ছিল না। একসময় রং মিস্ত্রি হিসেবে কাজ করতেন, তবে ভালো একটা চাকরির আশায় পড়াশোনা চালিয়ে যান। ব্যবস্থাপনা বিভাগে পড়াশোনা শেষ করার পর তাঁর স্বপ্ন ছিল কোনো কর্পোরেট অফিসে চাকরি করবেন, হয়তো ব্যাংকে বা সরকারি দপ্তরে স্থান পাবেন। কিন্তু বাস্তবতা ছিল অন্যরকম।
অসংখ্য চাকরির আবেদন করেছেন, পরীক্ষা দিয়েছেন, ইন্টারভিউতে অংশ নিয়েছেন। কিন্তু ভাগ্য তার জন্য কোনো দরজা খোলেনি। কোথাও বলা হয়েছে”অভিজ্ঞতার অভাব”, কোথাও শুনেছেন” সুপারিশ বা তদবির লাগবে”। টাকা দিয়ে চাকরি করার ক্ষমতা ছিল না, রাজনৈতিক ছত্রছায়াও ছিল না, তাই বারবার ব্যর্থ হয়েছেন।
দিনের পর দিন চেষ্টা করেও চাকরির দরজা না খুলতে দেখে একসময় হাল ছেড়ে দেন। সংসারের অভাব ক্রমেই বাড়তে থাকে। বাবা-মা বৃদ্ধ, কাজ করতে পারেন না। স্ত্রী সংসার, আর তৃতীয় শ্রেণিতে পড়া ছোট্ট মেয়ে জোবাইদার পড়াশোনা । সবকিছুই তার সামান্য উপার্জনের ওপর নির্ভরশীল। বাধ্য হয়ে জীবনের এই কঠিন বাস্তবতা মেনে নিয়েছেন।
“আমি পড়াশোনা করেছি, একটা ভালো চাকরির স্বপ্ন দেখেছি। কিন্তু এখন আমার পরিচয় কী? আমি একজন রিকশাচালক। সমাজে আমার কোনো সম্মান নেই, কেউ আমাকে গুরুত্ব দেয় না,”কথাগুলো বলার সময় তার চোখে জল জমে যায়। তাঁর নয় বছর বয়সী একমাত্র মেয়ে জোবাইদা, যার ছোট্ট দুটি চোখে বাবার জন্য গর্ব থাকার কথা, সেখানে আজ শুধুই হতাশার ছায়া।
জুলহাসের জীবনের গল্প শুধু তার একার নয়, হাজারো মেধাবী তরুণের গল্প, যারা সিস্টেমের ব্যর্থতার কারণে হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা কি পারি না এই মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াতে? এই সমাজ কি শুধু উচ্চবিত্তদের জন্য? শুধু সুপারিশ আর টাকার জোরেই কি চাকরি পাওয়া যাবে? তাহলে জুলহাসদের মতো মেধাবী, পরিশ্রমী তরুণদের কী হবে? প্রশ্ন রইল সমাজের উচ্চবিত্তদের কাছে! আর্থিক সাহায্য নয়, যোগ্যতা অনুযায়ী ভালো একটি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাই পারে জুলহাস এর জীবনে আলো ফেরাতে!