১৮২৯ সালের ডিসেম্বর মাসে ব্রিটিশ ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেনটিংক সতীদাহ নামে পরিচিত পরলোকগত স্বামীর চিতায় চড়িয়ে বিধবা স্ত্রীকে পুড়িয়ে দেয়ার প্রাচীন এক হিন্দু প্রথা আইন করে নিষিদ্ধ করেন।
সতীদাহ প্রথা কী?
সতীদাহ প্রথা হলো হিন্দু ধর্মাবলম্বী কোনো সদ্য বিধবা নারীকে স্বামীর চিতায় সহমরণ বা আত্মাহুতি দিতে বাধ্য করার এক অমানবিক প্রথা। কোন সময় সতীদাহ প্রথার উদ্ভব হয়, সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় না। তবে খ্রিষ্টপূর্ব ৪ শতকে দিগ্বিজয়ী সম্রাট আলেকজান্ডারের ভারত আগমনের বিবরণে সতীদাহ প্রথার সন্ধান মেলে। তা ছাড়া পৌরাণিক কাহিনিগুলোয় এমন আত্মাহুতির অনেক উদাহরণ রয়েছে।
‘সতী’ শব্দটি এসেছে দেবী সতীর নাম থেকে। রাজা দক্ষের কন্যা ও দেবতা শিবের স্ত্রী তিনি। রাজা দক্ষ সতীর সামনে শিবকে তিরস্কার করলে স্বামীর অপমান সহ্য করতে না পেতে তিনি আত্মাহুতি দেন। তা ছাড়া মহাভারতে পাণ্ডুর দ্বিতীয় স্ত্রী মাদ্রী স্বামীর সঙ্গে স্বেচ্ছায় সহমরণে গিয়েছিলেন। হিন্দু ধর্মের ধর্মগ্রন্থসমূহে সহমরণের এমন কিছু ঘটনার উল্লেখ পাওয়া গেলেও সতীদাহের আদেশ কোনো ধর্মগ্রন্থেই নেই। বরং বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে এমন অনেক নারী চরিত্র আছেন, যাঁরা স্বামীর মৃত্যুর পরও বেঁচে ছিলেন। ধর্মগুরুরা এসব পৌরাণিক কাহিনি ব্যবহার করেছেন সতীদাহ প্রথার নামে নারী হত্যার ক্ষেত্র তৈরিতে।
সতীদাহ প্রথা ছিল মূলত সামাজিক ও ধর্মীয় হত্যাকাণ্ড। মৃত ব্যক্তির সম্পত্তির দখল নিতে এবং পারিবারিক মানসম্মান নষ্ট হওয়ার ভয় থেকে মৃত ব্যক্তির আত্মীয়রা সদ্য বিধবা হওয়া নারীকে জোর করে স্বামীর চিতায় পুড়িয়ে মারতেন। তা ছাড়া ছেলে মারা যাওয়ায় তাঁর স্ত্রীকে বাড়িতে রাখা ঝামেলা মনে করা হতো। হত্যাই যেন এর সহজ ও একমাত্র সমাধান ছিল! বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে এই প্রথাচর্চার প্রবণতা অনেক বেশি ছিল।
ঢাকঢোল, শঙ্খ, ঘণ্টা ইত্যাদির আওয়াজ আর চারপাশের মানুষের হইহল্লার আড়ালে চাপা পড়ে যেত বিধবার কান্নার শব্দ। বিধবা নারীকে নববধূর মতো সাজিয়ে, সিঁদুর ও ফুলের মালা পরিয়ে, চন্দন ও আলতার রঙে রাঙিয়ে জ্বলন্ত চিতার ওপর তুলে দেওয়া হতো। অনেক সময় আফিমজাতীয় মাদকদ্রব্য খাইয়ে বা মাথার পেছনে আঘাত করে অজ্ঞান করে হাত-পা বেঁধে স্বামীর চিতায় তুলে ভস্ম করে দেওয়া হতো। চিতা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করলে বাঁশ বা কাঠ দিয়ে আঘাত করা হতো এবং ঠেলে দেওয়া হতো আগুনের ভেতর।
শত শত বছর ধরে চলে আসা এই নৃশংসতম প্রথা মোগল সম্রাট শাহজাহান বিলোপ করতে গিয়েও ব্যর্থ হন। তবে কোনো সদ্য বিধবা নারীর শিশুসন্তান থাকলে তাঁর সতীদাহ করার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলে এমন অনেক সতীদাহের ঘটনা ঘটত, যা সম্রাট বা তাঁর লোকজনের কানে পৌঁছাত না। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ার ভয়ে ইংরেজরাও এই প্রথার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে সাহস পাচ্ছিল না।
সতীদাহ প্রথা নিয়ে লর্ড বেনটিংক, যিনি ওই সময় বাংলার গভর্নর জেনারেল ছিলেন। ৪৯ জন সিনিয়র সামরিক কর্মকর্তা এবং পাঁচজন বিচারকের মতামত নিয়েছিলেন।
এরপর তিনি মনস্থির করেন ‘ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ওপর কালিমা লেপনকারী’ এই প্রথা বাতিলের সময় এসেছে।
তার জারি করা আইনে বলা হয় ‘সতীদাহ হলো মনুষ্য চরিত্রের মৌলিক অনুভূতির চরম বিরুদ্ধ একটি প্রথা’ এবং অনেক হিন্দুও এটিকে ‘বেআইনি এবং জঘন্য’ বলে বিবেচনা করেন।
আইনে বলা হয় হিন্দু কোনো বিধবাকে পোড়ানোর জন্য জবরদস্তি করা বা ওই কাজে সাহায্য অথবা উসকানি দেয়ার সাথে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে তাকে পরোক্ষ হত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হবে। এমনকি কোনো বিধবা যদি স্বেচ্ছায় সতীদাহ করতেও চায়, তাহলেও সতীদাহের সাথে যে কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতা অপরাধ বলে গণ্য করা হবে।
অপরাধীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার অধিকার দেয়া হয় আদালতকে।
সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে যেসব ভারতীয় আন্দোলন করছিলেন তারা ধীরে ধীরে পর্যায়ক্রমে তা বন্ধের সুপারিশ করেছিলেন। কিন্তু বেনটিংক শক্ত পথ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
তবে আইনটি জারির পর, রাজা রামমোহন রায়ের নেতৃত্বে তিন শ’ সুপরিচিত হিন্দু সমাজ সংস্কারক লর্ড বেনিটংককে ধন্যবাদ দেন। তাদের বিবৃতির ভাষা ছিল, ‘সজ্ঞানে নারী হত্যাকারী হিসাবে যে দুর্নাম আমাদের চরিত্রের সাথে জুড়ে গিয়েছিল তা থেকে চিরতরে আমাদের মুক্তি দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।’
তবে গোঁড়া হিন্দুরা আপত্তি তুললো। তারা আইনটি বাতিলের জন্য লর্ড বেনটিংকের কাছে অবেদন জানায়।
হিন্দু ধর্মে ‘সতীদাহ কোনো ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা নয়’ বলে যে কথা আইনের মুখবন্ধে বলা হয় তাকে ওই গোঁড়া হিন্দু নেতারা চ্যালেঞ্জ করলেন। যুক্তির পক্ষে তারা হিন্দু শাস্ত্রের এবং হিন্দু মুনিদের নানা উদ্ধৃতি তুলে ধরেন। কিন্তু বেনটিংক টললেন না।
উপায়ন্তর না দেখে ওই হিন্দু নেতারা প্রিভি কাউন্সিল নামে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সর্বোচ্চ আদালতের কাছে তাদের আর্জি নিয়ে গেলেন।
কিন্তু ১৮৩২ সালে প্রিভি কাউন্সিল তাদের আর্জি খারিজ করে সতীদাহ বিরোধী আইনটি বহাল রাখে। কাউন্সিল তাদের রায়ে বলেছিল, ‘সতীদাহ সমাজের বিরুদ্ধে জঘন্য একটি অপরাধ।’
ভারতে জাতপাত সম্পর্কিত আইনি ইতিহাস নিয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত ‘কাস্ট প্রাইড’ বইয়ের লেখক মনোজ মিত্তা বলেছেন, ‘১৮২৯ সালের আইনটি নিয়ে যে লড়াকু এবং আপোষহীন মনোভাব দেখা দিয়েছিল তা ১৯০ বছরের ঔপনিবেশিক শাসনামলে অন্য কোনো সামাজিক আইন প্রণয়নে দেখা যায়নি। গোঁড়া আবেগকে বিন্দুমাত্র প্রশ্রয় দেয়া হয়নি।’
মিত্তা তার বইতে লিখেছেন, ‘ব্রিটিশ শাসনের ওপর গান্ধী যে নৈতিক চাপ তৈরি করেছিলেন তার অনেক আগেই বেনটিংক ভারতে জাতপাত এবং লিঙ্গ বৈষম্য নিয়ে যেগুলো ছিল সতীদাহের মত প্রথার মূলে একই ধরনের নৈতিক চাপ আরোপ করেছিলেন ঔপনিবেশের প্রচলিত একটি প্রথাকে অপরাধ হিসাবে সাব্যস্ত করে।’
কিন্তু ১৮৩৭ সালে ভারতে আরেক ব্রিটিশ প্রশাসক টমাস ম্যাকাউলে, যিনি ভারতীয় পেনাল কোডের প্রণেতা ছিলেন। তিনি লর্ড বেনটিংকের ওই আইনকে লঘু করে ফেললেন।
পেনাল কোডের খসড়ায় ম্যাকাউলে লেখেন যদি অভিযুক্ত প্রমাণ দিতে পারে বিধবার জোরাজুরিতে সে চিতায় আগুন দিয়েছিল তাহলে তার সাজা লঘু করা যেতে পারে।
তার খসড়ায় ম্যাকাউলে লেখেন, যে নারী স্বেচ্ছায় স্বামীর চিতায় ওঠেন তারা হয়তো ‘ধর্মীয় দায়িত্ব বা শক্ত আত্মমর্যাদার বোধ’ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে থাকতে পারে।
মিত্তা লিখেছেন ম্যাকাউলের সেই ‘সহানুভূতিশীল অবস্থান’ কয়েক দশক পরে অন্য ব্রিটিশ শাসকদের প্রভাবিত করেছিল।
তিনি আরো লিখেন ম্যাকাউলের সেই খসড়া আইন ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের পর নতুন করে নজর পায়।
সতী বিরোধী আইনের কিছু বিধান লঘু করে ফেলা হয় এবং মিত্তা বলেন, তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ‘উচ্চবর্ণের হিন্দুদের খুশি করা। কারণ তারা সিপাহী বিদ্রোহে বড় ভূমিকা রেখেছিল।’
সতী বিরোধী আইনে হত্যায় প্ররোচনা দেয়ার বা হত্যাকারী হিসাবে দোষী সাব্যস্ত করার যে বিধান রাখা হয়েছিল সে দুটোই ১৮৬২ সালের বিধিতে বাতিল করা হয়।
ফলে, সতী মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তি এমন ব্যাখ্যা প্রমাণের সুযোগ পেয়ে যায়, যে বিধবা নারীটি স্বেচ্ছায় তার পরলোকগত স্বামীর চিতায় উঠেছিল এবং মামলাটি আসলে হত্যার নয়, বরঞ্চ আত্মহত্যার।
মিত্তা লিখেছেন সতী আইনটির বিধান লঘু করে ফেলার পেছনের কারণ ছিল ‘সামাজিক সংস্কারে করা বিভিন্ন আইনের বিরুদ্ধে দানা বেঁধে ওঠা অসন্তোষ,’ যেমন সতীদাহ নিষিদ্ধ করে আইন, একঘরে এবং ধর্মত্যাগী হিন্দুদের পারিবারিক সম্পত্তিতে অধিকার দিয়ে করা ১৮৫০ সালের একটি আইন এবং ১৮৫৬ সালের বিধবা বিবাহ আইন।
তবে সতীদাহ আইনটি লঘু করার পেছনে মূল যেটা কাজ করেছে তা হলো ‘উচ্চবর্ণের হিন্দু সৈনিকদের ক্রোধ’ যারা বন্দুকের কার্তুজে গরুর চর্বি মেশানোর গুজবে চরম ক্ষুব্ধ হয়েছিল।
১৮২৯ সালে যে সতীদাহকে হত্যার মত অপরাধ বলে বিধান করা হয়, ১৮৬২ সালে সেটি কার্যত হয়ে পড়ে একটি আত্মহত্যা।
‘যদিও ১৮২৯ সালে থেকে সতীদাহ কমতে শুরু করেছিল, তারপরও ভারতের কিছু অঞ্চলে সেটি অব্যাহত ছিল, এমনকি কিছু অঞ্চলে এই প্রথার গুণকীর্তন চলতেই থাকে, বিশেষ করে উচ্চবর্ণের হিন্দু সমাজে, বলেন মি মিত্তা।
১৯১৩ সালে বিস্ময়কর একটি ঘটনা ঘটে। আইনজীবী এবং কংগ্রেস রাজনীতিক মতিলাল নেহরু। যিনি ভারতের স্বাধীনতা অন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। উত্তর প্রদেশে সতীদাহের এক মামলায় অভিযুক্ত ছয়জন উচ্চবর্ণের হিন্দুর পক্ষে আদালতে দাঁড়ান।
ওই অভিযুক্তরা আদালতে দাবি করেন ‘ওই বিধবার পূণ্যের জোরে অলৌকিকভাবে চিতায় আগুন ধরে গিয়েছিল।’
বিচারক অবশ্য অলৌকিকত্বের ওই ব্যাখ্যা খারিজ করে দেন এবং ছয়জনকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেয়ার দোষে দোষী সাব্যস্ত করেন। দু’জনকে চার বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়।
৭০ বছর পর সতী বিষয়ক কাহিনীতে চূড়ান্ত এক মোড় নেয়। ১৯৮৭ সালে মতিলাল নেহরুর প্রপৌত্র রাজীব গান্ধীর সরকার একটি আইন প্রণয়ন করে যেখানে প্রথমবারের মতো ‘সতীদাহ প্রথার যে কোনো গুণকীর্তনকে’ অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হয়। এই অপরাধে সাত বছরের কারাদণ্ডের বিধান করা হয়।
ওই আইনে সতীদাহকে আবারও হত্যাকাণ্ড হিসাবে বিবেচনার বিধান রাখা হয় এবং এই অপরাধে মৃত্যুদণ্ডের বিধান ফিরিয়ে আনা হয়। রাজস্থান রাজ্যে রূপ কানওয়ার নামে অল্প বয়সী এক বধূকে চিতায় চড়ানোর এক ঘটনা নিয়ে দেশজুড়ে তুমুল হৈচৈ হওয়ার পর সতী-বিরোধী আইনকে কঠোর করার ওই উদ্যোগ নেয়া হয়।
মিত্তার মতে রূপ কানওয়ারকে চিতায় জ্বালিয়ে দেয়ার ওই ঘটনা ছিল ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর ভারতে সতীদাহের ৪১তম ঘটনা।
রাজীব গান্ধীর সময়ে করা আইনের ভূমিকাটি ছিল লর্ড বেনটিংকের করা আইনের মুখবন্ধের হুবহু।
‘অত ভেবেচিন্তে করা না হলেও নতুন আইনটি ছিল সাবেক এক উপনিবেশের পক্ষ থেকে একসময়কার ঔপনিবেশিক শাসকের প্রতি এক শ্রদ্ধার্ঘ,’ বলেন মিত্তা।
সূত্র : বিবিসি