অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নানা পদক্ষেপের পরও খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত সব পণ্যেই মূল্যস্ফীতি চরম পর্যায়ে রয়েছে। এর মধ্যে অর্থবছরের মাঝপথে এসে হঠাৎ শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট এবং সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়েছে সরকার। ফলে দেশের বাজারে সবজি ছাড়া নিত্যব্যবহার্য প্রায় সব পণ্যের দাম বেড়েছে। সাবান, টিস্যু, জুস, এলপি গ্যাসসহ অধিকাংশ পণ্য কিনতে বাড়তি টাকা গুনতে হচ্ছে ক্রেতাদের। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে নিত্যপণ্যের বাজারে এর প্রভাব পড়বে না। কিন্তু ব্যবসায়ী ও ক্রেতারা মনে করেন, নতুন করে ভ্যাট ও শুল্ক আরোপ করে বাজারকে আরো উসকে দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাজারে কোনো পণ্যের দাম বাড়লে তা অন্য পণ্যের ওপরও প্রভাব ফেলে। অর্থাৎ ভ্যাট ও শুল্ক বাড়ানোর প্রভাবে সামগ্রিকভাবে মূল্যস্ফীতি আরো বেড়ে যাবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, পরোক্ষ কর ধনী-গরিব সবার জন্যই সমান। পরোক্ষ কর বাড়লে ধনীদের সমস্যা হয় না, সমস্যা হয় গরিবের। এ ব্যাপারে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, কয়েক বছর ধরেই উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ রয়েছে। জিনিসপত্রের দামের স্তরও অনেক ওপরে উঠে গেছে। এতে সবাই হিমশিম খাচ্ছে। তাদের প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে। এখন নতুন শুল্ক-কর আরোপের ফলে এই শ্রেণির মানুষের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হবে। অর্থবছরের মাঝপথে শুল্ক-করে এত বড় পরিবর্তন এর আগে হয়েছে কিনা, জানা নেই।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, নানা কারণে গেল বছর নিত্যপণ্যের বাজার ছিল রীতিমতো অস্থির। দামের চাপে বছরজুড়ে গড় মূল্যস্ফীতি থেকেছে দুই অঙ্কের ঘরে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, গেল বছর গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৩৪ শতাংশ। তার আগের বছর ২০২৩ সালে এই হার ছিল ৯ দশমিক ৪৮। গত বছর উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে ছিল মানুষ। সে তুলনায় মানুষের আয় বাড়েনি। উল্টো বেড়েছে বেকারের সংখ্যা। বিবিএসের ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বেকারের সংখ্যা ছিল ২৬ লাখ ৬০ হাজার, যা এক বছর আগে ওই সময়ে ছিল ২৪ লাখ ৯০ হাজার। অর্থাৎ এক বছরে বেকার বেড়েছে ১ লাখ ৭০ হাজার। খরচ বাড়লেও মানুষের রোজগার বাড়েনি তেমন। উল্টো চাকরি খুইয়ে ধুঁকছেন অনেকে। এর মধ্যেই দুঃসংবাদ হয়ে হাজির শতাধিক পণ্য ও সেবায় নতুন শুল্ক-কর। সরকারের ঘোষণায় ইতোমধ্যে বেশ কিছু পণ্য ও সেবার খরচ বেড়ে গেছে। রেস্তোরাঁ-মালিকরা ক্রেতার কাছ থেকে বিলে বাড়তি ভ্যাট আদায় করছেন। পোশাকের নতুন দাম কার্যকর করছেন খাত
সংশ্লিষ্টরা। মোবাইল ফোনের কল ও ইন্টারনেটের বাড়তি খরচ কেটে নিচ্ছে অপারেটরগুলো। এতে খরচের গতি যেভাবে ছুটবে, তাতে জীবনযাত্রা ব্যয় সামাল দেয়া অনেকটাই দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে নির্ধারিত আয়ের মানুষের।
কারওয়ান বাজারে ইউনিলিভার বাংলাদেশের বহুল প্রচলিত ১০০ গ্রামের একটি লাক্স সাবান শুক্রবার বিক্রি হয়েছে ৬০ টাকায়; যা কয়েকদিন আগেও বিক্রি হয়েছে ৫৫ টাকায়। শুধু সাবান নয়; টিস্যু, জুসসহ বেশ কিছু পণ্য কিনতে এক রাতের ব্যবধানেই বাড়তি টাকা গুনতে হচ্ছে ক্রেতাদের।
শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট এবং সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর দুটি অধ্যাদেশ গত ৯ জানুয়ারি জারি করে সরকার, যা তাৎক্ষণিক কার্যকর হয়েছে। এতে এক রাতের মধ্যে লাক্স সাবানসহ প্রায় অধিকাংশ পণ্য ৫ থেকে ৬ টাকা বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে ক্রেতাদের। ব্যবসায়ীরা বলছেন, যেসব পণ্যের দাম এখনো বাড়েনি, সেগুলোর উৎপাদনকারী ও সরবরাহকারীরা বলছেন, পুরনো চালানের মজুত শেষ হয়ে নতুন পণ্য বাজারে এলে সেগুলোর দামও বাড়বে। নানা কারণে পণ্য উৎপাদন খরচ আগে থেকেই বেড়েছিল। এখন সরকার ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়ানোর কারণে খরচের সীমা মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে।
জানতে চাইলে কমলাপুর বাজার রোডের মুদি দোকানের বিক্রেতা আবদুস ছালাম বলেন, দাম বাড়াতে সরকারের নির্দেশ লাগে না। সরকার দাম বাড়াবে- এমন খবর কোম্পানিগুলো আগে থেকেই জানে। তিনি বলেন, বাজারে সব ধরনের টিস্যুর দাম বেড়েছে। কারওয়ান বাজারের বিক্রেতারা বলছেন, কোম্পানি থেকে আগে এক কার্টন টিস্যুতে ৬ পিস ফ্রি দেয়া হতো। কিন্তু শুক্রবার সকালে কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে কোম্পানিগুলো আর ফ্রি টিস্যু দেবে না। এতে আমাদের কিছুটা লাভ কমে যাবে; কিন্তু ক্রেতাদের জন্য আমাদের পক্ষ থেকে যে ছাড় দেয়া হতো, সেটি আর দেয়া যাবে না।
কারওয়ান বাজারে কেনাকাটা করতে এসেছেন আবদুর রহমান। জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকার পণ্যের ওপর ভ্যাট বাড়িয়েছে; কারণ সরকারেরও আয় প্রয়োজন। কিন্তু এমন সময় বাড়ানো হয়েছে, যখন সব পণ্যের দামই আকাশচুম্বী। এক রাতেই অনেক পণ্যের দাম বেড়েছে। কয়েকদিন পর কোম্পানিগুলোর নতুন পণ্য এলে সেগুলোও বাড়তি দামে কিনতে হবে। সরকারের উচিত, আয়ের জন্য জনগণ যা নিত্যব্যবহার করে, এমন পণ্যের চেয়ে বিলাসী পণ্যের দিকে নজর দেয়া।
ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো পণ্যের মধ্যে ফল, জুস, মিষ্টি, বেকারি ফুডও রয়েছে। আম, কমলালেবু, লেবুজাতীয় ফল, আঙুর, লেবু, পেঁপে, তরমুজ, আপেল ও নাশপাতি, ফলের রস, সবজির রস, তামাক, বাদাম, ফ্রæট ড্রিংকস, আর্টিফিশিয়াল বা ফ্লেভার ড্রিংকস ও ইলেকট্রোলাইট ড্রিংকস (কার্বোনেটেড ও নন-কার্বোনেটেড), তামাকযুক্ত সিগারেট মানুষকে আকৃষ্ট করে। কিন্তু এসব পণ্যে সম্পূরক শুল্ক ৫ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। আবার রেস্তোরাঁর খাবারের দামে নতুন ভ্যাট বসানোয় খাবারের দামও বাড়ানো হয়েছে।
সার্বিক ব্যাপারে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সাবেক সহসভাপতি ও ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক হাফেজ হারুন-অর-রশিদ বলেন, ভ্যাট দিয়েই আমরা ব্যবসা করতে চাই। তবে এমনিতেই তো অধিকাংশ পণ্যের দাম বেশি। মানুষের আয় বাড়েনি। ব্যবসায়ীদেরও বিক্রি বাড়েনি। লোকসান করে আমাদের ব্যবসা করতে হচ্ছে। এর মধ্যে হঠাৎ করে অর্থবছরের মাঝপথে যেভাবে বাড়তি শুল্ক ও ভ্যাটের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে তা ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে। সরকারের এ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে হবে। তা না হলে আমাদের অনেকের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে।
বিভিন্ন সুপারশপেও বেড়েছে ফল, সবজি থেকে শুরু করে নিত্যপণ্যের দাম। মালিবাগ মোড় স্বপ্ন আউটলেটে আসাদুর রহমান নামে এক ক্রেতা বলেন, সবকিছুর দাম এমনিতেই বেশি। অন্তর্বর্তী সরকার দাম না কমিয়ে শুল্ক, ভ্যাট বাড়িয়ে বাজারে উত্তাপ ছড়িয়ে দিয়েছে। কোনো মন্তব্য করতে চাই না। কারণ আমাদের কথা কেউ শুনবে না।
এছাড়া ব্র্যান্ডের পোশাকের দোকানগুলোতে ১ হাজার টাকায় বাড়তি দিতে হচ্ছে ১৫০ টাকা, যা আগে ছিল ৫০ টাকা। সিগারেটের দাম প্রতি প্যাকেটে বেড়েছে ৬০-৭০ টাকা। বিমানে যাতায়াতে খরচও বেড়েছে ৫০০ টাকা। বিমান ভ্রমণে আবগারি শুল্ক ২ হাজার থেকে বাড়িয়ে ইতোমধ্যে আড়াই হাজার টাকা নেয়া শুরু করেছে এয়ারলাইন্সগুলো।
ভ্যাট বাড়ানোর ফলে ইতোমধ্যে রডের দাম টনপ্রতি ১০ হাজার টাকা বেড়েছে। ৭৭-৭৮ হাজার টাকা টনের রড রাতারাতি এখন ৮৬-৮৭ হাজার টাকায় উঠে গেছে। ভ্যাট বাড়ানোর কারণে ভোক্তা পর্যায়ে ১২ কেজি এলপিজির দাম ৪ টাকা বাড়িয়ে ১৪৫৯ টাকা করা হয়েছে। গত ২ জানুয়ারি ভোক্তা পর্যায়ে ১২ কেজি এলপিজির দাম ১৪৫৫ টাকা নির্ধারণ করেছিল বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। গতকাল মঙ্গলবার (১৪ জানুয়ারি) ভ্যাট সমন্বয় করে নতুন এলপি গ্যাসের দর ঘোষণা দিয়েছে বিইআরসি। আদেশে কেজি প্রতি এলপি গ্যাসের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১২১ দশমিক ৫৬ টাকা, যা ভ্যাট বাড়ানোর আগে ছিল ১২১ দশমিক ১৯ টাকা। একই সঙ্গে অটো গ্যাসের দাম লিটার প্রতি ৬৬ দশমিক ৭৮ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৬৭ দশমিক ২৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
ইতোমধ্যে মোবাইল ফোনের খরচ বেড়েছে শতকরা ২ টাকা। অর্থাৎ আগে ১০০ টাকার কথা বললে ২৮ টাকা বাড়তি খরচ হতো। এখন তা ৩০ টাকা হচ্ছে। এর মধ্যে বাজারে ২৫ টাকার টিস্যু ২৮ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে অনেক জায়গায়। ৬০ টাকার বিস্কুট এখন ৭০ টাকা।
ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, নতুন করে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ীরা আরেক দফা মূল্য বাড়িয়ে সাধারণ মানুষের জীবন আরো দুর্বিষহ করে তুলবে।