মানব সভ্যতার ইতিহাসকে গৌরবান্বিত করেছে বেশ কয়েকজন মহামানব তাঁদের কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে, জীবনাচারের মধ্য দিয়ে বৈপ্লবিক বক্তব্যের মধ্য দিয়ে। তিনটি বক্তৃতাই পৃথিবীর ইতিহাসে খ্যাতনামা বক্তৃতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে এবং প্রত্যেকটি বক্তব্যই মানুষের মুক্তির জন্য, স্বাধীনতার জন্য, ভ্রাতৃত্ব এবং শুদ্ধতা প্রতিষ্ঠার জন্য। এগুলি হচ্ছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ১৬শ প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের “গেটিসবার্গ অ্যাড্রেস” এবং মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের “আই হ্যাভ এ ড্রিম” বক্তৃতা। বক্তৃতাগুলি মানুষের মুক্তির দলিল হিসেবে পৃথিবীর সর্বত্র আলোচনা, গবেষণা এবং প্রচার হয়ে থাকে। এগুলির আবেদন দিন দিন বেড়েই চলছে এবং প্রজন্মের পর প্রজন্ম অনুপ্রাণিত হচ্ছে।
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, ইতিহাসের মহানায়ক, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ বাঙালির রত্নভান্ডার। ভিনদেশী শাসকগোষ্ঠীর সুদীর্ঘকালের শাসন, শোষণ, অত্যাচার, অনাচারের বিরুদ্ধে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুদীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম এবং এ দেশের মুক্তিকামী মানুষের স্বাধীনতার দিগন্ত উন্মোচনের অদম্য স্পৃহার ক্লাইম্যাক্স হিসেবে বক্তৃতাটিকে বিবেচনা করা যায়। বক্তৃতাটি যেন এক অলৌকিক জাদুমন্ত্রের মতো সকলকে আকৃষ্ট করে, বিপ্লবী মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করে, স্বাধীনতা এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে উজ্জীবিত করে। বক্তৃতাটি অসাধারণ কাব্যিক গুণে গুণান্বিত। যতবার আমরা বক্তৃতারটি শুনি ততোবারই আমরা উদ্দীপ্ত বোধ করি। সেখানে ব্রিটিশ শাসন-শোষণের প্রত্যক্ষ ইঙ্গিত যেমন রয়েছে, রয়েছে বর্বর পাকিস্তানি শাসকদের রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের জঘণ্যতম ইতিবৃত্ত। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচন, ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র আন্দোলন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন,১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের ঐতিহাসিক বাস্তবতার ধারাবাহিক প্রেক্ষাপটে বক্তৃতাটি যেন বাঙালির ধারাবাহিক আন্দোলন-সংগ্রামের ক্লাইম্যাক্স হিসেবে আমাদের জীবনে আশীর্বাদ হয়ে এসেছিল।
১৮ মিনিটের বক্তৃতায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রতিটি বাঙালির প্রাণের চাওয়া-পাওয়াকে উচ্চারণ করেছিলেন। তাঁর বজ্রকণ্ঠে উচ্চারিত ন্যায্য অধিকারের দলিল যেন তিনি উপস্থাপন করেন সেদিন। সুদীর্ঘকালের পাকিস্তানি স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বক্তৃতাটি ছিল পুঞ্জিভূত ঘৃণার বিস্ফোরণ। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের রেসকোর্স ময়দানই শুধু প্রকম্পিত হয় নি বক্তৃতাটি দ্বারা, তৎকালীন সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানও প্রকম্পিত হয়েছিল এ বক্তব্যে। কার্যত, গোটা বাংলাদেশই সেদিন কার্যত রেসকোর্স ময়দানে পরিণত হয়েছিল। ইতিহাসের ধারাবাহিক ঘটনাপঞ্জী সেখানে যেমন ছিল, ছিল স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে তীব্র দ্রোহ, ঘৃণা এবং শৃঙ্খল ভাঙ্গার গান। তাঁর বক্তব্যে বাঙালির অদম্য ইচ্ছাশক্তি এবং আত্মমর্যাদাবোধকেও ফুটিয়ে তুলেছেন– ” আমাদের কিছুতেই দাবায়ে রাখতে পারবা না।” বক্তৃতায় তিনি তীব্র বিশ্বাসের সাথে স্বাধীনতা এবং মুক্তির ডাক দেন–” তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই, নিয়ে প্রস্তুত থাকো” এবং ” এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।” অকুতোভয় বাঙালি জাতি সেদিন জাতির পিতার আহবানে মুক্তিসংগ্রামে শামিল হয়। মূলত ৭ই মার্চেই তিনি স্বাধীনতার কথা ব্যক্ত করেছিলেন। একজন দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তিনি মুক্তির রূপরেখা দিয়েছিলেন তাঁর জাতিকে। দেশটিকে যদি একটি জাহাজের সাথে তুলনা করা যায় তাহলে বলা যায়, তিনি যেন সেই জাহাজের ক্যাপ্টেন হিসেবে জাহাজটিকে সুনির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে ধাবিত করছিলেন। এত বলিষ্ঠ এবং সাহসী উচ্চারণ আর কারও দ্বারাই সম্ভব ছিল না।
একটি বক্তৃতার শ্রেষ্ঠত্ব নির্ভর করে তার ভাষার ব্যবহারে, তথ্যের প্রতুলতায়, উপজীব্য বিষয়ের গভীরতায়, উপস্থাপন শৈলীতে, ভাষার বৈচিত্র্যে, প্রাসঙ্গিকতায়, শব্দালঙ্কারের ব্যবহারে, সুস্পষ্ট ও সাহসী উচ্চারণে, কৌতূহল-উদ্দীপক এবং প্রাণসঞ্চারী বার্তায়, বৈপ্লবিক চেতনা তৈরির ক্ষমতায় এবং আবেগের জাগরণে। পাশাপাশি প্রয়োজন হয় বক্তার সম্মোহনী ব্যক্তিত্ব, নাটকীয়তা এবং আত্মপ্রত্যয়। সকল বিবেচনায় ৭ই মার্চের বক্তৃতা অনন্যসাধারণ। কবি নির্মলেন্দু গুণ এ বক্তৃতাটিকে বাঙালির অমর কবিতা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। প্রকৃতপক্ষেই এটি আমাদের প্রাণসঞ্চারী কবিতা। সেদিনে এ রাজনীতির কবির তর্জনীর ইঙ্গিতে জেগে উঠেছিল গোটা জাতি। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের জন্য তারা সর্বশক্তি নিয়ে জেগে উঠেছিল। তাঁর উচ্চারণে ছিল সম্মোহনী জাদুমন্ত্র। কথাগুলি হৃদয়ের গহীন থেকে উঠে আসা সতস্ফুর্ত অনুভূতির উৎসারণ। বক্তৃতার কেন্দ্রভূমি হয়ে উঠেছিল ৫৬ হাজার বর্গমাইলের সবুজ-শ্যামল, স্বাধীন মানচিত্র এবং সবুজের বুকে লাল সূর্য খচিত পতাকা। এ ভাষণটির মধ্যেই নিহিত ছিল আমাদের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন জাতিসত্তা।
ইউনেস্কো অক্টোবর ৩০, ২০১৭ সালে Memory of the International World’s Register- এর Important Documentary Heritage হিসেবে বক্তৃতাটি গ্রহণ করেছে। এটি পৃথিবীতে জাতি হিসেবে আমাদের অনন্য মর্যাদা এনে দিয়েছে। শুধু বাংলাদেশেই নয়, এখন গোটা বিশ্বে এটি এক অনন্য দলিল হিসেবে স্বীকৃত।
এবারে আসা যাক “The Gettysburg Address” প্রসঙ্গে। ১৮৬৩ সালের ১৯ নভেম্বর আমেরিকার ষোড়শ প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন পেনসিলভেনিয়া অঙ্গরাজ্যে অবস্থিত গেটিসবার্গে এ বক্তৃতাটি দিয়েছিলেন। American Civil War- এর প্রেক্ষাপটে বক্তৃতা।১৭৭৬ সালে আমেরিকা স্বাধীনতা লাভ করলেও নিগ্রোরা প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ করতে পারেনি। তাদের সংবিধানে যদিও শুরুতেই উচ্চারিত হয়েছে বাইবেল নির্ভর আপ্তবাক্য “All men are created equal”, আফ্রো-আমেরিকানরা তাদের নাগরিক অধিকার লাভ করতে পারে নি। ফলশ্রুতিতে, স্বাধীনতা প্রাপ্তির ৮৭ বছর পরে আব্রাহাম লিংকন আমেরিকার ষোড়শ প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিগ্রোদের ক্রীতদাসত্ব থেকে মুক্ত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। তিনি যখন আমেরিকাকে ক্রীতদাস মুক্ত হিসেবে Emancipation Proclamation বা মুক্তির ঘোষণা জারি করেন তখন তার অনেক শুভানুধ্যায়ী বলেছিলেন এরূপ সিদ্ধান্ত নিতে। তারা বলেছিলেন এ সিদ্ধান্ত পরবর্তী নির্বাচনে তার জন্য নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। জবাবে তিনি বলেছিলেন,” I am not a politician ; i m a statesman. A politician thinks of the next election but a statesman thinks of the next generation.” অর্থাৎ, ” আমি কোনও রাজনীতিবিদ নই ; আমি রাষ্ট্রনায়ক। একজন রাজনীতিবিদ পরবর্তী নির্বাচন নিয়ে চিন্তা করেন কিন্তু একজন রাষ্ট্রনায়ক পরবর্তী প্রজন্ম নিয়ে চিন্তা করেন।” Emancipation Proclamation জারি করার পর আমেরিকায় গৃহযুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে আমেরিকা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে– Confederate States ( Southern States) এবং Union States ( Northern States)। গৃহযুদ্ধের দীর্ঘ রক্তস্নাত পথ বেয়ে আমেরিকা অবশেষে ক্রীতদাস মুক্ত হয়। এ প্রেক্ষাপটে তিনি পেনসিলভেনিয়া অঙ্গরাজ্যের গেটিসবার্গে মাত্র তিন মিনিটের একটি বক্তৃতা করেন। এ বক্তৃতায় তিনি মানুষের শৃঙ্খলমুক্তির কথা বলেছেন এবং গণতন্ত্রের সংজ্ঞা দিয়েছেন ” Government of the people, by the people and for the people”. এ বক্তৃতার মধ্যে তিনি খুব সংক্ষিপ্ত পরিসরে আমেরিকার শাসনতন্ত্রের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন, দাস প্রথার বিরুদ্ধচারন করেছেন, স্বাধীনতাকে অর্থবহ করার কথা বলেছেন, মানুষের মর্যাদার কথা বলেছেন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের কথা বলেছেন। এত সংক্ষিপ্ত পরিসরে এত বস্তুনিষ্ট বক্তব্য পৃথিবীতে আর নেই। এ বক্তৃতাটির তিনি দিয়েছিলেন ১৮৬৩ সালের ১৯শে নভেম্বর। বক্তৃতাটি পৃথিবীর ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। বক্তৃতার মধ্যে epigrammatic brevity বা প্রজ্ঞানির্ভর সংক্ষিপ্ততা আমাদের অবাক করে। আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে গণতন্ত্রের এত সুন্দর সংজ্ঞা আর কেউ দিতে পারে নি।
এবার আসা যাক মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র-এর পৃথিবীবিখ্যাত বক্তৃতা “I Have a Dream” প্রসঙ্গে। ১৮৬৫ সালের ১৫ই এপ্রিল আব্রাহাম লিংকন আততায়ীর গুলিতে নিহত হবার পর ধীরে ধীরে আমেরিকাতে আবার দাস প্রথা জেঁকে বসে। তাঁর মৃত্যুর পর প্রায় ১০০ বছর নিগ্রোদের দাসত্বের শৃংখলে পুণরায় আবদ্ধ হতে হয়। তার মুক্তির ঘোষণা বা Emancipation Proclamation বহুলাংশে অকার্যকর হয়ে পড়ে। নিগ্রোরা রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে প্রচন্ড বৈষম্যের শিকার হতে থাকে। তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয় দশকের পর দশক। তাদেরকে ghetto ( এক ধরনের খোয়াড়)- এর মধ্যে মানবেতর জীবন যাপন করতে হয়,পাহাড়ের ঢালে বাস করতে হয়। দিনান্তে পরিশ্রম শেষে তারা হোটেলে, মোটেলে থাকার সুযোগ পায়নি। পাবলিক যানবাহনে তাদের আসুন বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে। সেগ্রিগেটেড স্কুলে তাদের পড়াশোনা করতে হয়েছে। রাষ্ট্রীয়, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তাদের প্রতিনিধিত্ব অর্জিত হয়নি। যখন তারা অধিকারের কথা বলতে গেছে, তখনই তাদের পুলিশি নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। এ হৃদয় বিদারক পরিস্থিতিতে সিভিল রাইটস্ মুভমেন্ট শুরু হয়। সিভিল রাইটস্ মুভমেন্টে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র একসময় নেতৃত্ব আসেন। আন্দোলন হিসেবে তিনি nonviolent movement বা অহিংস আন্দোলন কে বেছে নেন। হেনরি ডেভিড থোরা এবং মহাত্মা গান্ধীর অহিংস আন্দোলনের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। পুলিশি নির্যাতন এবং কারাবরণ তাকে করতে হয়। ১৯৬৩ সালের ২৮শে আগস্ট মেমোরিয়াল হলের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে তিনি লক্ষাধিক দর্শক-শ্রোতার উপস্থিতিতে “আই হ্যাভ এ ড্রিম” বক্তৃতাটি প্রদান করেন।
“আই হ্যাভ এ ড্রিম” বক্তৃতাটি শুধু আমেরিকাতেই নয়, সমগ্র বিশ্বে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনকে তীব্র থেকে তীব্রতর করেছিল। পরবর্তীতে সাউথ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী প্রখ্যাত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা এ বক্তব্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম অব্যাহতভাবে চালিয়ে যান। সারাবিশ্বে মানবতাবাদ এবং বর্ণবাদ বিরোধী চেতনা গড়ে ওঠে। এ বক্তৃতার আলোকে কৃষ্ণাঙ্গদের শিল্পসাহিত্য, নন্দনতত্ত্ব প্রভাবিত হয়। আফ্রো-আমেরিকানরা আজ আমেরিকাসহ সারাবিশ্বে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। এর ভিত্তিভূমি রচনা করেছিলেন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র তার “আই হ্যাভ এ ড্রিম” বক্তৃতায়।
“আই হ্যাভ এ ড্রিম” বক্তৃতার মতো কাব্যিক বক্তৃতা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। বক্তৃতাটির মধ্যে ব্যবহৃত শব্দালঙ্কার, প্রতীকের ব্যবহার, উপমা-উপ্রেক্ষা, অনুপ্রাসের ব্যবহার অসাধারণ। পাশাপাশি, ইতিহাসচেতনা, মানবতাবোধ, বর্ণবৈষম্যবাদবিরোধী বিপ্লবী চেতনা, একাগ্রতা, দার্শনিকতা, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা একাকার হয়ে মিশে আছে। বক্তৃতাটি শুধুমাত্র লিংকন মেমোরিয়াল হল সংলগ্ন জায়গায় সীমাবদ্ধ থাকেনি, গোটা আমেরিকায় তো বটেই, সমগ্র পৃথিবীতে এক সুবিশাল জাগরণ তৈরি করে। এ জাগরণ ছিল বর্ণবৈষম্যবাদ এর বিরুদ্ধে, নৈরাজ্য, স্বৈরতন্ত্র, এবং কর্তৃত্বপরায়নতার বিরুদ্ধে। বক্তৃতাটির মধ্যে যেমন রয়েছে অসুন্দরের প্রতি, অন্যায়ের প্রতি, অবিচারের প্রতি দ্রোহ, তেমনি রয়েছে সত্যের প্রতি, সুন্দরের প্রতি, ন্যায্যতার প্রতি সীমাহীন প্রেম। যতবার বক্তৃতাটি পড়া যায়, ততোবারই তা কাছে টানে। সংবেদনশীল পাঠকের কাছে এ বক্তৃতার গুরুত্ব কখনই কমবে না। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তাঁর বক্তৃতায় ভীষণভাবে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রকে অনুকরণ করেছেন। তাঁর বিভিন্ন বক্তৃতায় তিনি মার্টিন লুথার কিংয়ের রেফারেন্স ব্যবহার করেছেন।
তিনটি বক্তৃতায় মিল রয়েছে অনেক। মানবিক বোধের সঞ্চারে, কর্তৃত্ব পরায়নতা রুখে দাঁড়াতে, নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা, দমন নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিটি বক্তৃতা সোচ্চার প্রতিবাদ। একই ভাবে স্বাধীনতার স্বপ্ন ছড়িয়ে দিতে, বিপ্লবী মন্ত্র ছড়িয়ে দিতে বক্তৃতা তিনটির গুরুত্ব অপরিসীম। বক্তৃতাগুলির সাহিত্যমূল্য, নান্দনিক বিন্যাস, দার্শনিক গুরুত্ব, ঐতিহাসিক গুরুত্ব অবিনশ্বর। বলা হয়ে থাকে ” Great men think alike” অর্থাৎ, কীর্তিমান মানুষেরা একই রকম চিন্তা করেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন এবং মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র- সকলেই রাষ্ট্রনায়কোচিত গুণাবলীতে ঋদ্ধ। বিশ্বের সকল মানুষের জন্যই তাঁরা মুক্তিদাতা। প্রত্যেকটি বক্তৃতাই অলৌকিক অর্কেসট্রার মত আমাদের বিমোহিত করে, আমাদের হৃদয়ে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মত বিপ্লবী চেতনা জাগিয়ে তোলে। তিনটি বক্তৃতাই সারা পৃথিবীতে একাডেমিক ডিসকোর্স হিসেবে পরিগণিত হয়ে থাকে। এগুলি নিয়ে বিস্তর আলোচনা, বিশ্লেষণ, গবেষণা চলছে এবং চলবে। বক্তৃতাগুলি আমাদের যাপিত জীবন, আমাদের শিল্প সাহিত্যকে প্রভাবিত করে। আমাদের সংকটকালীন সময়ে এগুলি স্থান-কাল-পাত্রের গণ্ডি পেরিয়ে আমাদের জন্য আশাবাদ বয়ে আনে, আমাদের শক্তি, সাহস এবং উদ্দীপনা দেয়।
তবে একটি জায়গায় বৈপরীত্য পাওয়া যায়। প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন লিখিত বক্তৃতা দিয়েছেন, মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র ও লিখিত বক্তৃতা দিয়েছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লিখিত বক্তৃতা পাঠ করেন নি। সে বিবেচনায় ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ আরো বেশী গুরুত্ববহ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ নিহিত ছিল এ ভাষণে। সবগুলি বক্তৃতা ভীষণ ক্রান্তিকালে প্রদত্ত হলেও আমাদের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা প্রাপ্তির প্রাথমিক দলিল হিসেবে ৭ই মার্চের বক্তৃতাটিকে গ্রহণ করা যায়।
পরিতাপের সাথে বলতে হয়, আরেকটি সাযুজ্য তিনজনের ক্ষেত্রেই পাওয়া যায়, আর তা হচ্ছে তিনজনই আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছেন। তবে, ১৫ই আগস্টের পৈশাচিক, বর্বরোচিত এবং মর্মান্তিক ঘটনা পৃথিবীতে আর নেই।