জলরাশির মাঝে সবুজে ঘেরা একটি দ্বীপ। দূর থেকে দেখলে চোখ ভরে আসে তার সবুজ বাহারে। অথচ এই দ্বীপে পা রাখলেই শিউরে উঠতে হয়। আলো-ছায়ার মাঝে এই দ্বীপের প্রতিটা গাছ থেকেই যেন ঝুলে রয়েছে একাধিক শিশু!
‘দ্য আইল্যান্ড অব ডলস’, ছোট্ট এক দ্বীপ। ভয়ঙ্কর সব পুতুল ওই দ্বীপের বাসিন্দা। ওইসব পুতুলের কোনোটার হাত নেই, কোনোটার পা নেই, কোনোটার আবার চোখ বা মাথা নেই। চারদিকে সবুজ, নিস্তব্ধতার মধ্যে বাতাসে দোল খাচ্ছে এইসব ভয়ঙ্কর পুতুল। সব মিলিয়ে গা ছমছমে দ্বীপটির পরিবেশ। অনেক সাহসী বীরেরও বুক কেঁপে ওঠে এই দ্বীপটিতে গেলে।
মেক্সিকো সিটি থেকে ১৭ মাইল দক্ষিণে সোচিমিলকোতে ওই রহস্যময় পুতুল দ্বীপের অবস্থান। দ্বীপটি ঘিরে ছড়িয়ে আছে নানা কিংবদন্তি। কথিত আছে, এই দ্বীপে পুতুল নিয়ে খেলছিলো তিন মেক্সিকান শিশু। খেলাচ্ছলে তারা পুতুলের বিয়ে দেয়। খেলার সময়ে হঠাৎ একটি শিশু উধাও হয়ে যায়। অনেক খোঁজাখুঁজির পর পাশের একটি খালে সেই শিশুটির মৃতদেহ পাওয়া যায়। সেই থেকে সাধারণ মানুষের কাছে এই দ্বীপটি হয়ে ওঠে ভয়ঙ্কর এক দ্বীপ এবং লোকমুখে প্রচলিত হয়ে আসছে দ্বীপটিকে ঘিরে নানা কাহিনী।
কেউ মুণ্ডহীন, কারও হাত-পা কাটা, কারও আবার সারা শরীর যেন কেউ ছিঁড়ে নিয়েছে। যতদূর চোখ যাবে এই দৃশ্যই চোখে পড়বে। ঘোর কাটলে বুঝতে পারবেন, ওগুলো আসলে পুতুল। সব গাছ থেকেই ঝুলছে ছোট-বড় এমন নানা চেহারার পুতুল।
নির্জন দ্বীপে কোথা থেকে এল এত পুতুল? কেই বা গাছে সেগুলো ঝুলিয়ে দিল? উত্তর জানতে গেলে কয়েক বছর পিছনে হাঁটতে হয়। মেক্সিকো সিটির দক্ষিণে এই দ্বীপের নাম ‘দ্য আইল্যান্ড অব ডলস’।
পরিবার ত্যাগ করে জনমানবশূন্য এই দ্বীপে এক সময় বসবাস করতে শুরু করেন ডন জুলিয়ান সান্তানা বরেরা নামে এক ব্যক্তি। জুলিয়ান নামে এই ব্যক্তির জীবনের সঙ্গেই লুকিয়ে রয়েছে এই পুতুল দ্বীপের রহস্য।
বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে স্ত্রী ও পরিবার ত্যাগ করেছিলেন জুলিয়ান। শুধু পরিবারের থেকেই নিজেকে আলাদা করে নেননি, সমাজ থেকেও নিজেকে আলাদা করে নিয়ে থাকতে শুরু করেন এই নির্জন দ্বীপে।
জানা যায়, এই দ্বীপে বসবাস করতে শুরু করার কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি নাকি দ্বীপে ঝোপ-জঙ্গলে ঢাকা একটি নালা থেকে এক বাচ্চা মেয়ের মৃতদেহ উদ্ধার করেন।
জুলিয়ানের দাবি, পাশের একটি হ্রদে মেয়েটি ডুবে গিয়েছিল। তারপর তার শরীর ভেসে আসে এই নালায়। এর কিছু দিন পর নালার ঠিক ওই একই জায়গায় একটি পুতুলও ভেসে আসে
এরপর থেকেই জীবন বদলে যায় জুলিয়ানের। সারা দিনই বাচ্চা মেয়ের ফিসফিস শুনতে পেতে শুরু করেন তিনি। তার খেলার শব্দ, ছুটে বেড়ানোর শব্দও কানে আসতে শুরু করে তাঁর।
ভীত জুলিয়ান বাচ্চা মেয়েটির আত্মাকে শান্ত করার একটা উপায় বার করে নিলেন। নালা থেকে তুলে এনে পুতুলটি পাশেই একটা গাছে ঝুলিয়ে দিলেন আর নিজেকে ওই দ্বীপের রক্ষাকর্তা ভেবে বসলেন।
এরপর থেকে জীবনের বাকি ৫০টি বছর ওই দ্বীপেই কাটান তিনি। বিভিন্ন জায়গা থেকে এমন সব নানা পরিত্যক্ত পুতুল তুলে এনে দ্বীপের গাছগুলিতে ঝোলাতে শুরু করেন। একটি একটি করে দ্বীপের প্রায় সব গাছই ভরে যায় পরিত্যক্ত পুতুলে।
২০০১ সালে ডন জুলিয়ানের মৃত্যুও হয় রহস্যজনক ভাবে। যে নালায় বাচ্চা মেয়েটির মৃতদেহ দেখার দাবি করেছিলেন তিনি, ঠিক সেখানেই ডুবে মারা যান জুলিয়ান। তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে এই পুতুল দ্বীপের রহস্যও চাপা পড়ে গিয়েছে
সত্যিই জুলিয়ান নালায় কোনও বাচ্চা মেয়ের মৃতদেহ দেখেছিলেন কি না, তার আত্মা এই দ্বীপে ঘুরে বেড়াত কি না, সে সবের উত্তর এখনও অজানা।
এই পুতুলগুলো দ্বীপে আপনা-আপনি আসেনি। ডন জুলিয়ান সানতানা নামের এক লোক ১৯৫০ সালের দিকে এই দ্বীপটিকে ধ্যান করার জন্য বেছে নেন। তার কাছে নাকি মৃত শিশুটির আত্মা আবদার করেছিলো যে, অনেক পুতুল এনে দ্বীপের চারপাশে টাঙিয়ে দেয়ার জন্য। এরপরই জুলিয়ান তার আশ্রমে চাষের সবজির বিনিময়ে মানুষের কাছ থেকে নষ্ট পুতুল সংগ্রহ করতে থাকেন এবং দ্বীপের নানা জায়গায় টাঙিয়ে দিতেন শিশুটির আত্মাকে খুশি করার জন্য। এভাবেই দ্বীপের প্রত্যেকটি গাছে, পরিত্যক্ত বাড়িতে ঝুলে আছে পুতুলগুলো। অনেকে মনে করেন এ সবই জুলিয়ানের মনগড়া কাহিনী। দীর্ঘ ৫০ বছর তিনি এই দ্বীপে একাকি বসবাস করেন।
এ দ্বীপে ২০০১ সালের এপ্রিল মাসে ঘটে যায় এক রহস্যময় ঘটনা। ওইদিন ডন জুলিয়ান সেই খালটিতে মাছ ধরছিলেন, যে খালে শিশুটির মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল। হঠাৎ তার মনে হয়, পানির নিচ থেকে কেউ একজন তাকে ডাকছে। এর কিছুদিন পর সেখান থেকে উদ্ধার হয় ডন জুলিয়ানের মৃতদেহ।
প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণা দূর করতে মেক্সিকান সরকার ১৯৯০ সালে এই দ্বীপটিকে ‘ন্যাশনাল হেরিটেজ’ ঘোষণা করে এবং দ্বীপটিকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে পর্যটন এলাকা বানানোর উদ্যোগ নেয়। কিন্তু পর্যটকরা কদাকার পুতুল দেখে রাতে দুঃস্বপ্ন দেখেন এই অজুহাতে দ্বীপটিতে যেতে ভয় পান। সারা বছরে খুব বেশি পর্যটক এই দ্বীপে আসেন না। আর সেখানে পর্যটকেরা গেলে এখনো সাথে করে পুতুল নিয়ে যান এবং টাঙিয়ে দেন দ্বীপের কোনো এক জায়গায়।
মানুষের চেনা বাস্তবতার বাইরেও কি আর একটি জগত আছে? হয়তোবা সেখানে সত্যিই ঘুরে বেড়ায় মৃত মেয়েটির আত্মা। আবার হয়তো এমন কিছুই নেই সেখানে। পুরো ব্যাপারটাই মানব মনের কল্পনা। তবে, এতটুকু নিশ্চিত করে বলা যায় বাস্তবতা কিংবা কল্পনার রহস্য ঘেরা এই দ্বীপ এখনো অনেক অজানা প্রশ্ন তৈরি করে যাচ্ছে।