ফরিদপুরের সালথায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বাসভবন, উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) অফিস, উপজেলা চেয়ারম্যানের বাসভবন, উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্স ভবন, উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন ও থানায় ব্যাপক তাণ্ডব চালিয়েছে স্থানীয় উত্তেজিত জনতা। এ সময় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জুবায়ের হোসেন (২০) নামে যুবক নিহত হয়েছেন।
সোমবার (৫ এপ্রিল) সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১১ পর্যন্ত কয়েক হাজার মানুষ উপজেলা চত্বরে দেশীয় অস্ত্র ঢাল-কাতরা ও লাঠিসোটা নিয়ে প্রবেশ করে বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় এই তাণ্ডব চালায়। হামলাকারীরা তিনঘণ্টাব্যাপী এ ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। তাদের এই হামলা থেকে রক্ষা পায়নি উপজেলা পরিষদ চত্বরের গাছপালা ও বঙ্গবন্ধুর মুর্যাল। এতে সালথা উপজেলা সদর এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। পুলিশ টিয়ার গ্যাস ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এ ঘটনায় জুবায়ের হোসেন (২০) নামে যুবক নিহত হয়েছেন। তিনি উপজেলার রামকান্তপুর ইউনিয়নের রামকান্তপুর গ্রামের আশরাফ আলী মোল্যার ছেলে। এ ঘটনায় আট পুলিশ-র্যাব সদস্যসহ আহত হয়েছেন অন্তত ৩০ জন।
এরআগে, সোমবার সন্ধ্যায় করোনা ঠেকাতে বিধিনিষেধ কার্যকর করতে দুই আনসার সদস্য ও ব্যক্তিগত সহকারীকে নিয়ে সালথা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মারুফা সুলতানা খান হিরামণি ফুকরা বাজারে যান। সে সময় চা পান করতে আসা জাকির হোসেন নামের এক ব্যক্তিকে লাঠিপেটা করা হয় বলে স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ। এই ঘটনার জেরে পরে ফুকরা বাজারে পুলিশের সঙ্গে স্থানীয় লোকজনের বাকবিতণ্ডা হয়। এরপর সেখানে সালথা থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে একদল পুলিশ পৌঁছালে উত্তেজিত লোকজন পুলিশের ওপর হামলা করে। এতে মিজানুর রহমানের মাথা ফেটে যায়।
পরে পুলিশের গুলিতে দুইজন নিহত ও জনৈক মাওলানাকে গ্রেপ্তারের গুজব ছড়িয়ে পড়ে। হাজারো মানুষ এসে থানা ঘেরাও করে। পরে উপজেলা পরিষদ, থানা, সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কার্যালয়, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বাসভবন, উপজেলা কৃষি অফিস, সাব-রেজিস্ট্রি অফিস, উপজেলা চেয়ারম্যানের বাসভবন ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এসময় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার গাড়ি ও সহকারী কমিশনারের (ভূমি) গাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। সালথা উপজেলা সদর এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।
সালথা উপজেলা নির্বাহী অফিসার হাসিব সরকার বলেন, স্থানীয় জনতা পুলিশের গুলিতে দুইজনের মৃত্যু ও জনৈক মাওলানাকে গ্রেপ্তারের পর তাকে মারপিট করা হচ্ছে গুজব ছড়িয়ে দেয়। এমন গুজবে হাজারো মানুষ এসে থানা ঘেরাও করে। পরে আমার বাসভবন, উপজেলা পরিষদ, সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কার্যালয়সহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এসময় আমার গাড়ি ও সহকারী কমিশনারের (ভূমি) গাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
এদিকে এসিল্যান্ড মারুফা সুলতানা খান হিরামণি জানান, তিনি রুটিন ওয়ার্কে বিভিন্ন বাজারে গিয়েছিলেন। এর অংশ হিসেবে ফুকরা বাজারে যান। সেখানে দুটি দোকান খোলা ছিল, তাদের বন্ধ করতে বলা হয়েছিল। মারধরের কোনো ঘটনা ঘটেনি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আরও বলেন, গুজব ছড়িয়ে পরিকল্পিতভাবে এ হামলা চালানো হয়েছে।
সালথা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ওয়াদুদ মাতুব্বর জানান, আমার বাসভবনসহ বিভিন্ন অফিস ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। গুজব ছড়িয়ে এ হামলা চালানো হয়েছে। সুপরিকল্পিতভাবে বিএনপি, জামায়াত ও হেফাজতের নেতাকর্মীরা এই হামলা চালিয়েছে।
ফরিদপুরের পুলিশ সুপার মো. আলিমুজ্জামান বিপিএম বলেন, লকডাউনের প্রথমদিনে সরকারি নির্দেশনা পালন করতে গিয়ে স্থানীয় জনতার সঙ্গে কর্মকর্তাদের ভুল বোঝাবুঝি হয়। এক পর্যায়ে স্থানীয়রা মিজানুর নামে এক এসআইকে মারপিট করে। এরপর তারা গুজব ছড়িয়ে পরিকল্পিতভাবে উপজেলা পরিষদ, থানা ও উপজেলা চেয়ারম্যানের বাসভবনসহ বিভিন্ন অফিস ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে।
তিনি আরও বলেন, তিন ঘণ্টাব্যাপী ধ্বংসযজ্ঞ চালায় তারা। তাদের এই হামলা থেকে রক্ষা পায়নি উপজেলা কমপ্লেক্সের গাছপালা, বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালসহ নানা স্থাপনা। রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষার্থে ও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সালথা থানা পুলিশের পাশাপাশি ফরিদপুর, বোয়ালমারী, ভাঙ্গা ও নগরকান্দা পুলিশ সদস্য সহ র্যাব, আনসার সদস্যরা ৫৮৮ রাউন্ড শর্ট গানের গুলি, ৩২ রাউন্ড গ্যাস গান, ২২ টি সাউন্ড গ্রেনেড এবং ৭৫ রাউন্ড রাইফেলের গুলি ছোড়ে।
তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আট সদস্যসহ আহত হয়েছেন কমপক্ষে ২০ জন। আহতদের মধ্যে স্থানীয় জুবায়ের নামে এক যুবক চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন।
তিনি আরও বলেন, ঘটনাস্থল ও আশপাশের এলাকায় বিপুল সংখ্যাক পুলিশ ও র্যাব মোতায়েন করা হয়েছে। ভিডিও ফুটেজ দেখে হামলাকারীদের শনাক্তের চেষ্টা চলছে। মামলার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।