মোবাইল অ্যাপ টিকটক ভিডিওর কথা বলে ঘর থেকে বের হওয়ার পর আন্তর্জাতিক নারী পাচারকারী চক্রের খপ্পরে পড়েন রাজধানীর হাতিরঝিল থানা এলাকার এক তরুণী। ওই তরুণী দেশে ফিরে পুলিশের কাছে ভারতে টানা ৭৭ দিন ভয়ানক নির্যাতনের রোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন।
ওই তরুণীর বরাত দিয়ে সাংবাদিকদের ঘটনার বিবরণ দেন বুধবার সকালে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তেজগাঁও বিভাগরে উপকমিশনার মো. শহীদুল্লাহ।
তিনি বলেন, ভারতে পাচার হওয়া এক কিশোরী হাতিরঝিল থানায় মামলা করেছেন। এই মামলায় সাতক্ষীরা সীমান্ত এলাকা থেকে মেহেদী হাসান বাবু, মহিউদ্দিন ও আব্দুল কাদের নামে তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে মেহেদী হাসান প্রায় এক হাজার নারী পাচারে জড়িত থাকার তথ্য দিয়েছেন।
উপকমিশনার জানান, ২০২১ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়া জেলায় বাউল লালন শাহ মাজারে আয়োজিত টিকটক হ্যাংআউটে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে আন্তর্জাতিক মানব পাচারকারী খপ্পরে পড়েন ওই তরুণী। চক্রের সদস্যদের সহযোগিতায় কৌশলে ভিকটিমকে ভারতে পাচার করে রিফাতুল ইসলাম হৃদয় ওরফে টিকটক হৃদয় বাবু। পাচারকারী চক্রের খপ্পরে পড়ার পর থেকে পালিয়ে দেশে ফেরা পর্যন্ত তাকে নির্যাতনের করুণ কাহিনি কল্পনাকেও হার মানিয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ওই তরুণী পুলিশকে বলেন, ভারতে পাচারের পর তাকে বেঙ্গালুরুতে আনন্দপুর এলাকায় পর্যায়ক্রমে কয়েকটি বাসায় রাখা হয়। এ সময় পাচার হওয়া আরও কয়েকজন বাংলাদেশি নারীকে দেখতে পান তিনি। যাদের সুপার মার্কেট, সুপার শপ বা বিউটি পারলারে উচ্চ বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে ভারতে পাচার করা হয়। বেঙ্গালুরুতে পৌঁছার কয়েক দিন পরই ভিকটিমকে চেন্নাইয়ের ও ওয়াইকিউ হোটেলে ১০ দিনের জন্য পাঠানো হয়। সেখানে অমানবিক শারীরিক ও বিকৃত যৌন নির্যাতনে বাধ্য করা হয়। সেখানে তার প্রতি সামান্য দয়াও দেখায়নি কেউ। বরং কৌশলে ও জোরপূর্বক মাদক সেবন করিয়ে বিবস্ত্র ও ধর্ষণের ভিডিও ধারণ করা হয়। পুলিশ জানায়, এসব ভিডিও দেশে পরিবারের সদস্য এবং পরিচিতদের পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে জিম্মি করে রাখা হয়। এভাবে টানা ৭৭ দিন তাকে নির্যাতন করা হয়। একপর্যায়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। পরে এক তরুণীর সহযোগিতায় সহযোগিতায় বেঙ্গালুরু থেকে পালিয়ে আসেন ভিকটিম। দেশে এসে হাতিরঝিল থানায় মামলা করেন।
মামলার এজাহারনামীয় ১২ আসামির মধ্যে পাঁচজন বাংলাদেশে অবস্থান করার প্রাথমিক তথ্য পেয়েছে পুলিশ।
মামলার বাদী তরুণী জানান, ২০১৯ সালে হাতিরঝিলে আসামি টিকটক হৃদয় বাবুর সঙ্গে পরিচয় হয়। কখনো টিকটক স্টার বানানো, কখনো আবার উচ্চ বেতনে ভারতে চাকরির অফার দিয়ে ভিকটিমকে প্রলুব্ধের চেষ্টা করে হৃদয় বাবু।
ভিকটিম তরুণী জানান, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নারায়ণগঞ্জের অ্যাডভেঞ্চার ল্যান্ড পার্কে ৭০ থেকে ৮০ জনকে নিয়ে টিকটক হ্যাংআউট করে। একই বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর গাজীপুরের আফরিন গার্ডেন রিসোর্টে ৭০০ থেকে ৮০০ তরুণ-তরুণীকে নিয়ে বিশাল পুল পার্টির আয়োজন করে টিকটক হৃদয়। ২০২১ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়ায় বাউল লালন শাহ মাজারে টিকটিক হ্যাংআউটে নেয়ার কথা বলে ভারতে পাচার করে।
পুলিশ জানায়, মঙ্গলবার সাতক্ষীরা জেলার সীমান্তবর্তী দাবকপাড়া কালিয়ানী এলাকা থেকে ভিকটিমকে ভারতে পাচারে জড়িত তিন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়। আসামিদের কাছ থেকে পাচারের ব্যবহৃত দুটি মোটরসাইকেল, একটি ডায়েরি, চারটি মোবাইল ফোন ও একটি ভারতীয় সিম কার্ড উদ্ধার করা হয়েছে।
উপকমিশনার জানান, গ্রেপ্তার মেহেদী হাসান বাবু (৩৫) মামলার ভিকটিমসহ এক হাজারের বেশি নারী পাচারে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে। সে প্রায় ৭ থেকে ৮ বছর ধরে মানবপাচারে জড়িত। তার কাছ থেকে উদ্ধার মোবাইল ও ডায়েরিতে টিকটক হৃদয় বাবু, সাগর, সবুজ, ডালিম ও রুবেলের ভারতীয় মোবাইল ফোন নম্বর পাওয়া গেছে। পাশাপাশি তার কাছ থেকে উদ্ধার ডায়েরিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ভাইরাল ভিডিওর ঘটনার ভিকটিমের ভারতীয় নম্বর পাওয়া গেছে। এ ছাড়া ভারতে পাচার হওয়া উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভিকটিমের নাম ও মানবপাচারে জড়িত ব্যক্তিদের বিস্তারিত তথ্য পাওয়া গেছে।
পুলিশ জানায়, অপর দুই আসামি মহিউদ্দিন ও আব্দুল কাদের পাঁচ শতাধিক তরুণীকে সীমান্তবর্তী এলাকায় পাচারের কাজে ব্যবহারের জন্য ঘর ভাড়া নেয়। সেখানে অবস্থান করে পারাপারে সহায়তার পাশাপাশি মোটরসাইকেলে সীমান্তের শেষ প্রান্তে ভারতীয় দালালের হাতে তুলে দেওয়ার কথা স্বীকার করেছে।