ফিলিস্তিনের গাজায় গণহত্যামূলক আগ্রাসন তৃতীয় বছরে পা দিয়েছে। এ আগ্রাসনে এ পর্যন্ত ৬৭ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। যাদের মধ্যে শুধু শিশুই ২০ হাজারের বেশি। এ সময় ১২৫টি হাসপাতাল ও ক্লিনিক গুঁড়িয়ে দিয়েছে বর্বর বাহিনী। সেখানে অনাহারে মারা গেছেন ৪৫৯ জন, যার মধ্যে শিশু ১৫৪টি। গাজা উপত্যকার ৯২ শতাংশ স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করেছে ইসরায়েল। মোট আবাসনের ৯২ ও ৮৮ শতাংশ বাণিজ্যিক ধ্বংস্তূপে পরিণত হয়েছে। এ ঘটনাকে জাতিংঘসহ বিশ্বসংস্থাগুলো গণহত্যা বলে আখ্যায়িত করেছে।
এ হত্যাযজ্ঞে বিশ্বজুড়ে ক্ষোভ বাড়লেও ইসরায়েলকে এখনো অর্থায়ন ও অস্ত্র সরবরাহ করে চলেছে একাধিক দেশ ও প্রতিরক্ষা শিল্প প্রতিষ্ঠান। ফলে গণহত্যার অভিযোগ সত্ত্বেও টিকে আছে তেল আবিবের যুদ্ধযন্ত্র।
২০২০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ইসরায়েলের অস্ত্র আমদানির বড় অংশই এসেছে যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানি থেকে। ইতালি ও যুক্তরাজ্যও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। এর বাইরে ইউরোপ ও এশিয়ার বেশকিছু সরবরাহকারী এবং ইসরায়েলের নিজস্ব প্রতিরক্ষা শিল্প এই অস্ত্র সরবরাহ নেটওয়ার্ককে সচল রেখেছে। তুরস্কের রাষ্ট্র পরিচালিত সংবাদ সংস্থা আনাদোলু এক পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনে দেখিয়েছে, কীভাবে দেশ ও কোম্পানিগুলো এখনো ইসরায়েলকে অস্ত্র জোগাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র: ওয়াশিংটন ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় অস্ত্র সরবরাহকারী ও রাজনৈতিক মিত্র। গাজায় যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নিয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে একাধিকবার ভেটো দিয়েছে তারা। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (সিপ্রি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ইসরায়েলের মোট অস্ত্র আমদানির প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে।
বর্তমানে ইসরায়েলে যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক সামরিক সহায়তা ৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২৮ পর্যন্ত চলবে। এর বড় অংশই মার্কিন সামরিক সরঞ্জামে খরচ করতে হয়। তবে এর বাইরে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি মজুত থেকে বিশাল অস্ত্র সহায়তা পাঠিয়েছে। সংঘাতের প্রথম বছরই অন্তত ৬ বিলিয়ন ডলারের গোলাবারুদ পাঠানো হয়েছে। বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করছেন, অনুমোদিত চুক্তিসহ এই পরিমাণ ২২ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারে।
এর মধ্যে আছে অ্যাটাক হেলিকপ্টার, শহর এলাকায় যুদ্ধ পরিচালনা উপযোগী যানের জন্য ১ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি, স্পেয়ার পার্টস ও ডেস্ট্রয়ারের জন্য ৭৫০ মিলিয়ন ডলারসহ কয়েকটি বড় সরবরাহ। ২০২৫ সালের শুরুর দিকেই কংগ্রেস নতুন দুটি চুক্তি অনুমোদন করেছে—একটি ৮ বিলিয়ন ডলারের (বোমা, ক্ষেপণাস্ত্র ও গোলাবারুদ), আরেকটি ৭ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারের (বোমা, গাইডেন্স কিট, হেলফায়ার মিসাইল)। এগুলোর সরবরাহ ২০২৫ থেকে ২০২৮ সালের মধ্যে হবে।
এসব সরবরাহে সক্রিয় মার্কিন প্রতিরক্ষা জায়ান্টগুলো—বোয়িং, লকহিড মার্টিন, রেথিয়ন, নর্থথ্রপ গ্রুম্যান, হানিওয়েল, কলিন্স এয়ারোস্পেস, জিই অ্যাভিয়েশন, প্র্যাট অ্যান্ড হুইটনি, মুগ ও এল ৩ হ্যারিস। তারা ইসরায়েলকে ফাইটার জেট, গোলাবারুদ, বিমান প্রযুক্তি ও সহায়ক ব্যবস্থা সরবরাহ করছে।
ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘কস্ট অব ওয়ার প্রজেক্ট’-এর দুই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাওয়া বিপুল আর্থিক সহায়তা না থাকলে ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারত না। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত ইসরায়েলকে ওয়াশিংটনের দেওয়া সহায়তার অঙ্ক ২১ বিলিয়ন ডলারের বেশি।
জার্মানি: সিপ্রির তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ইসরায়েলের অস্ত্র আমদানির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এসেছে জার্মানি থেকে। ইউরোপের অন্যান্য দেশের বিপরীতে বার্লিন ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি এবং ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্র হয়ে আছে। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৫ সালের মে মাসের মধ্যভাগ পর্যন্ত জার্মানি ৪৮৫ মিলিয়ন ইউরোর অস্ত্র রপ্তানির অনুমোদন দিয়েছে। যদিও ২০২৪ সালে সরবরাহ কিছুটা কমেছে, তবে সামগ্রিকভাবে ইসরায়েলের অন্যতম প্রধান সরবরাহকারী হয়ে উঠেছে জার্মানি।
প্রধান সরবরাহের মধ্যে আছে নৌবাহিনীর ফ্রিগেট, টর্পেডো এবং রাইনমেটালের তৈরি ১২০ মিমি নির্ভুল ট্যাংক গোলা। জার্মান সংবাদমাধ্যম ডার স্পাইজেলের তথ্যে বলা হয়েছে, এগুলো গাজায় স্থল অভিযানে ব্যাপকভাবে ব্যবহার হচ্ছে। ২০২৪ সালে রাইনমেটালের বিক্রি ৫৮ শতাংশ বেড়েছে।
এ ছাড়া আ্যাটলাস ইলেকট্রনিক ইসরায়েলের ডলফিন-ক্লাস সাবমেরিন রক্ষণাবেক্ষণে কাজ করছে ইসরায়েলি কোম্পানি ভিসেন্স টেকনোলজিসের সঙ্গে। অন্যদিকে, বেসামরিক খাতও জড়িত। জার্মানির মার্সিডিজ বেঞ্জ তৈরি করছে ভারী ট্রাক, যা ইসরায়েলের মেরকাভা ট্যাংক বহন করতে ব্যবহৃত হচ্ছে।
ইতালি: সিপ্রির তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ইসরায়েলের মোট অস্ত্র আমদানির ১ শতাংশ এসেছে ইতালি থেকে। এর মধ্যে ৫৯ শতাংশ হালকা হেলিকপ্টার এবং ৪১ শতাংশ জার্মান ফ্রিগেটের জন্য নৌ কামান। ইতালি এফ-৩৫ প্রোগ্রামেও অংশ নিচ্ছে এবং উপাদান তৈরি করছে। আলত্রেকোনোমিয়ার এক তদন্তে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালে ইতালি ৫ দশমিক ২ মিলিয়ন ইউরোর অস্ত্র রপ্তানি করেছে ইসরায়েলে।
যুক্তরাজ্য: যুক্তরাজ্য সম্প্রতি ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিলেও ইসরায়েলে অস্ত্র রপ্তানি চালিয়ে যাচ্ছে। ২০২৫ সালের আগস্টে ব্রিটেন থেকে ইসরায়েলে ১ লাখ ১০ হাজার গুলি পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছে চ্যানেল ৪। ২০২৪ সালের ২ সেপ্টেম্বর যুক্তরাজ্য সরকার ইসরায়েলের জন্য দেওয়া প্রায় ৩৫০টি অস্ত্র রপ্তানি লাইসেন্সের মধ্যে ৩০টি স্থগিত করে। কারণ ছিল, এগুলো গাজায় ব্যবহারের ‘স্পষ্ট ঝুঁকি।’ তবে বাকি অনেক লাইসেন্স বহাল ছিল, যার মধ্যে আছে নৌ প্ল্যাটফর্ম, প্রশিক্ষণ বিমান ও দ্বৈত ব্যবহারযোগ্য যন্ত্রাংশ।
অন্যান্য সরবরাহকারী: যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ইতালি ও যুক্তরাজ্যের বাইরে ইসরায়েল পাচ্ছে ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা। ফ্রান্সের সাফরান বিমান ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশ দিচ্ছে। দক্ষিণ কোরিয়ার হুনিড টেকনোলজিস সরবরাহ করছে ওয়্যারিং হারনেস ও ককপিট সিস্টেম।
সব মিলিয়ে এই যুদ্ধ শুধু ইসরায়েল ও গাজার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এর পেছনে দাঁড়িয়ে আছে বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত এক অস্ত্র নেটওয়ার্ক। ফিলিস্তিনিদের মৃত্যু বাড়লেও এই নেটওয়ার্ক আরও শক্তিশালী হয়ে উঠছে।