ঢাকা ০২:০১ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৫, ২৯ আশ্বিন ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

বৈশ্বিক খাদ্য ব্যবস্থার ওপর আঘাত হানছে ইউক্রেন যুদ্ধ

ইউক্রেন আক্রমণের মাধ্যমে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে অনেক দূরের মানুষের জীবনও ধ্বংস করছেন। আর এই ধ্বংযজ্ঞের মাত্রা এত বেশি হতে যাচ্ছে, যা দেখে হয়তো তিনি অনুশোচনাও করতে পারেন। কোভিড-১৯, জলবায়ু পরিবর্তন এবং জ্বালানির আকস্মিক সংকটে ইতোমধ্যে দুর্বল হয়ে যাওয়া বৈশ্বিক খাদ্য ব্যবস্থার ওপর আঘাত হানছে এই যুদ্ধ।

ইউক্রেনের শস্য ও তেলবীজের রপ্তানির বেশিরভাগই বন্ধ হয়ে গেছে এবং রাশিয়ার রপ্তানিও হুমকির মুখে পড়েছে। বিশ্ববাজারে সরবরাহকৃত মোট ক্যালোরির প্রায় ১২ শতাংশ আসে এই দুই দেশ থেকে। চলতি বছরের শুরুর দিকে বিশ্ববাজারে গমের দাম ৫৩ শতাংশ বেড়েছে। এছাড়া উদ্বেগজনক তাপপ্রবাহের কারণে ভারত গত ১৬ মে গমের রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় আরও ৬ শতাংশ দাম বৃদ্ধি পেয়েছে এই খাদ্যশস্যের।

প্রধান প্রধান বিভিন্ন খাবারের উচ্চ মূল্যের কারণে পর্যাপ্ত খাবারের নিশ্চয়তা নেই এমন মানুষের সংখ্যা ইতিমধ্যে বিশ্বে ৪৪ কোটি থেকে বেড়ে ১৬০ কোটিতে দাঁড়িয়েছে। আরও প্রায় ২৫ কোটি মানুষ দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে রয়েছেন। যদি যুদ্ধ চলতে থাকে এবং বিশ্ববাজারে রাশিয়া ও ইউক্রেনের সরবরাহ সীমিত হয়, তাহলে আরও কয়েক কোটি মানুষ দারিদ্র্যের কবলে পড়তে পারেন। এর ফলে রাজনৈতিক অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়বে, শিশুদের জীবন থমকে যাবে এবং মানুষকে অনাহারে থাকতে হবে।

প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন খাবারকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করবেন না বলে আশা অনেকের। যুদ্ধের অনিবার্য ফল অভাব নয়, ক্ষুধাকে বৈশ্বিক সমস্যা হিসেবে বিশ্ব নেতাদের দেখা উচিত। আর এ জন্য জরুরিভিত্তিতে বৈশ্বিক সমাধান প্রয়োজন।

বিশ্বজুড়ে লেনদেনকৃত মোট গমের ২৮ শতাংশ, বার্লির ২৯ শতাংশ, ভুট্টার ১৫ শতাংশ এবং সূর্যমুখী তেলের ৭৫ শতাংশ সরবরাহ করে রাশিয়া ও ইউক্রেন। লেবানন ও তিউনিসিয়ার আমদানিকৃত খাদ্যশস্যের প্রায় অর্ধেকই রাশিয়া ও ইউক্রেনের; লিবিয়া এবং মিসরের ক্ষেত্রে তা প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ।

আগ্রাসনের আগেই বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) ২০২২ সাল ভয়াবহ একটি বছর হবে বলে সতর্ক করে দিয়েছিল। বিশ্বের বৃহত্তম গম উৎপাদনকারী চীন বলেছে, বৃষ্টির কারণে গত বছর রোপণ বিলম্বিত হওয়ায় এই ফসলের উৎপাদন সবচেয়ে খারাপ হতে পারে। চরম বৈরী তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের অভাবে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম উত্পাদনকারী ভারতের পাশাপাশি আমেরিকান অঞ্চলের গমের বেল্ট থেকে ফ্রান্সের বিউস অঞ্চলের রুটির ঝুড়ি হিসেবে পরিচিত এলাকায়ও এর ফলন হুমকির মুখে পড়েছে।

মিসরে মানুষের ক্যালোরির চাহিদার প্রায় ৩০ শতাংশ পূরণ করে রুটি। অনেক আমদানিকারক দেশের সরকার দরিদ্রদের সহায়তা বৃদ্ধির জন্য ভর্তুকির ব্যয় বহন করতে পারছে না। বিশেষ করে অস্থিতিশীল বাজারের জ্বালানি আমদানি করেও ভর্তুকি দেওয়া যাচ্ছে না।

সংকট আরও ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ইউক্রেন ইতিমধ্যে দেশটিতে যুদ্ধ শুরুর আগে মজুতকৃত গত গ্রীষ্মের ফসলের বেশিরভাগই রপ্তানি করেছে। অতিরিক্ত ব্যয় এবং পরিবহনকারীদের ঝুঁকি সত্ত্বেও রাশিয়া এখনও খাদ্য শস্য বিক্রি করছে। তবে যুদ্ধে ইউক্রেনের গুদামগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। সেগুলো ভুট্টা এবং বার্লিতে পূর্ণ রয়েছে।

শস্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় কৃষকরা বিশ্বের অন্য স্থান থেকেও ঘাটতি পূরণ করতে পারছে না। এর অন্যতম কারণ হলো অস্থিতিশীল দাম। তবে আরও ভয়াবহ সংকট হলো সার ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির কারণে লাভের পরিমাণ সঙ্কুচিত হচ্ছে। এসবই কৃষকদের প্রধান ব্যয়। নিষেধাজ্ঞা এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের সংকট উভয় বাজারকে নাড়িয়ে দিয়েছে। কৃষকরা যদি সারের ব্যবহার কমিয়ে দেন, তাহলে ভুল এই সময়ে বিশ্বজুড়ে ফসলের উৎপাদন কমে যাবে।

উদ্বিগ্ন রাজনীতিকদের প্রতিক্রিয়া খারাপ পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে তুলতে পারে। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর কাজাখস্তান থেকে কুয়েত পর্যন্ত বিশ্বের অন্তত ২৩টি দেশ খাদ্য রপ্তানিতে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। আর এসব দেশের রপ্তানি বিশ্বজুড়ে সরবরাহকৃত মোট খাদ্যের প্রায় ১০ শতাংশের যোগান দেয়। বিশ্বে সারের মোট রপ্তানির এক-পঞ্চমাংশেরও বেশি সীমিত হয়েছে। চলমান এই সংকটে যদি বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায় তাহলে দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে।

Tag :
জনপ্রিয়

বৈশ্বিক খাদ্য ব্যবস্থার ওপর আঘাত হানছে ইউক্রেন যুদ্ধ

Update Time : ০২:৪৬:৫৮ অপরাহ্ন, রবিবার, ২২ মে ২০২২

ইউক্রেন আক্রমণের মাধ্যমে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে অনেক দূরের মানুষের জীবনও ধ্বংস করছেন। আর এই ধ্বংযজ্ঞের মাত্রা এত বেশি হতে যাচ্ছে, যা দেখে হয়তো তিনি অনুশোচনাও করতে পারেন। কোভিড-১৯, জলবায়ু পরিবর্তন এবং জ্বালানির আকস্মিক সংকটে ইতোমধ্যে দুর্বল হয়ে যাওয়া বৈশ্বিক খাদ্য ব্যবস্থার ওপর আঘাত হানছে এই যুদ্ধ।

ইউক্রেনের শস্য ও তেলবীজের রপ্তানির বেশিরভাগই বন্ধ হয়ে গেছে এবং রাশিয়ার রপ্তানিও হুমকির মুখে পড়েছে। বিশ্ববাজারে সরবরাহকৃত মোট ক্যালোরির প্রায় ১২ শতাংশ আসে এই দুই দেশ থেকে। চলতি বছরের শুরুর দিকে বিশ্ববাজারে গমের দাম ৫৩ শতাংশ বেড়েছে। এছাড়া উদ্বেগজনক তাপপ্রবাহের কারণে ভারত গত ১৬ মে গমের রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় আরও ৬ শতাংশ দাম বৃদ্ধি পেয়েছে এই খাদ্যশস্যের।

প্রধান প্রধান বিভিন্ন খাবারের উচ্চ মূল্যের কারণে পর্যাপ্ত খাবারের নিশ্চয়তা নেই এমন মানুষের সংখ্যা ইতিমধ্যে বিশ্বে ৪৪ কোটি থেকে বেড়ে ১৬০ কোটিতে দাঁড়িয়েছে। আরও প্রায় ২৫ কোটি মানুষ দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে রয়েছেন। যদি যুদ্ধ চলতে থাকে এবং বিশ্ববাজারে রাশিয়া ও ইউক্রেনের সরবরাহ সীমিত হয়, তাহলে আরও কয়েক কোটি মানুষ দারিদ্র্যের কবলে পড়তে পারেন। এর ফলে রাজনৈতিক অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়বে, শিশুদের জীবন থমকে যাবে এবং মানুষকে অনাহারে থাকতে হবে।

প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন খাবারকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করবেন না বলে আশা অনেকের। যুদ্ধের অনিবার্য ফল অভাব নয়, ক্ষুধাকে বৈশ্বিক সমস্যা হিসেবে বিশ্ব নেতাদের দেখা উচিত। আর এ জন্য জরুরিভিত্তিতে বৈশ্বিক সমাধান প্রয়োজন।

বিশ্বজুড়ে লেনদেনকৃত মোট গমের ২৮ শতাংশ, বার্লির ২৯ শতাংশ, ভুট্টার ১৫ শতাংশ এবং সূর্যমুখী তেলের ৭৫ শতাংশ সরবরাহ করে রাশিয়া ও ইউক্রেন। লেবানন ও তিউনিসিয়ার আমদানিকৃত খাদ্যশস্যের প্রায় অর্ধেকই রাশিয়া ও ইউক্রেনের; লিবিয়া এবং মিসরের ক্ষেত্রে তা প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ।

আগ্রাসনের আগেই বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) ২০২২ সাল ভয়াবহ একটি বছর হবে বলে সতর্ক করে দিয়েছিল। বিশ্বের বৃহত্তম গম উৎপাদনকারী চীন বলেছে, বৃষ্টির কারণে গত বছর রোপণ বিলম্বিত হওয়ায় এই ফসলের উৎপাদন সবচেয়ে খারাপ হতে পারে। চরম বৈরী তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের অভাবে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম উত্পাদনকারী ভারতের পাশাপাশি আমেরিকান অঞ্চলের গমের বেল্ট থেকে ফ্রান্সের বিউস অঞ্চলের রুটির ঝুড়ি হিসেবে পরিচিত এলাকায়ও এর ফলন হুমকির মুখে পড়েছে।

মিসরে মানুষের ক্যালোরির চাহিদার প্রায় ৩০ শতাংশ পূরণ করে রুটি। অনেক আমদানিকারক দেশের সরকার দরিদ্রদের সহায়তা বৃদ্ধির জন্য ভর্তুকির ব্যয় বহন করতে পারছে না। বিশেষ করে অস্থিতিশীল বাজারের জ্বালানি আমদানি করেও ভর্তুকি দেওয়া যাচ্ছে না।

সংকট আরও ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ইউক্রেন ইতিমধ্যে দেশটিতে যুদ্ধ শুরুর আগে মজুতকৃত গত গ্রীষ্মের ফসলের বেশিরভাগই রপ্তানি করেছে। অতিরিক্ত ব্যয় এবং পরিবহনকারীদের ঝুঁকি সত্ত্বেও রাশিয়া এখনও খাদ্য শস্য বিক্রি করছে। তবে যুদ্ধে ইউক্রেনের গুদামগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। সেগুলো ভুট্টা এবং বার্লিতে পূর্ণ রয়েছে।

শস্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় কৃষকরা বিশ্বের অন্য স্থান থেকেও ঘাটতি পূরণ করতে পারছে না। এর অন্যতম কারণ হলো অস্থিতিশীল দাম। তবে আরও ভয়াবহ সংকট হলো সার ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির কারণে লাভের পরিমাণ সঙ্কুচিত হচ্ছে। এসবই কৃষকদের প্রধান ব্যয়। নিষেধাজ্ঞা এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের সংকট উভয় বাজারকে নাড়িয়ে দিয়েছে। কৃষকরা যদি সারের ব্যবহার কমিয়ে দেন, তাহলে ভুল এই সময়ে বিশ্বজুড়ে ফসলের উৎপাদন কমে যাবে।

উদ্বিগ্ন রাজনীতিকদের প্রতিক্রিয়া খারাপ পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে তুলতে পারে। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর কাজাখস্তান থেকে কুয়েত পর্যন্ত বিশ্বের অন্তত ২৩টি দেশ খাদ্য রপ্তানিতে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। আর এসব দেশের রপ্তানি বিশ্বজুড়ে সরবরাহকৃত মোট খাদ্যের প্রায় ১০ শতাংশের যোগান দেয়। বিশ্বে সারের মোট রপ্তানির এক-পঞ্চমাংশেরও বেশি সীমিত হয়েছে। চলমান এই সংকটে যদি বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায় তাহলে দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে।