১৫ বছর ধরে শিকল পড়ার অবসান হলো। চিকিৎসার জন্য রবিউলকে পাঠানো হলো পাবনায় অবস্থিত মানসিক হাসপাতালে। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে ওই হাসপাতালে ভর্তি করা হয় রবিউলকে। ফরিদপুরের বোয়ালমারীর শিকল বন্দি রবিউলকে আর মাটি খুঁড়তে হবে না।
মঙ্গলবার সকাল ৬টার দিকে একটি মাইক্রোবাসে করে রবিউলকে প্রশাসনের উদ্যোগে পাবনার হেমায়েতপুরে পাঠানো হয়। এসময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন বাবা নুরুল মোল্লা ও ফুপু সাজেদা বেগম।
বোয়ালমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ঝোটন চন্দের উদ্যোগে উপজেলা সমাজ সেবার অর্থায়নে রবিউলকে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়াও বোয়ালমারী থানার ওসি মোহাম্মদ নুরুল আলম ব্যক্তি উদ্যোগে নগদ অর্থ ও একটি মাইক্রোবাস দিয়ে রবিউলকে পাবনা পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।
এর আগে গত ৩১ জুলাই ইউএনও ওই বাড়িতে পরিদর্শনে গিয়ে নগদ ৫ হাজার টাকাসহ সরকারি খাদ্য সহায়তা করেন। তাছাড়া গত সোমবার (২ আগষ্ট) বিকেলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে উপজেলা সমাজসেবা দপ্তরের মাধ্যমে মানসিকভাবে অসুস্থ রবিউল ইসলামের বাবার হাতে আরো ৫ হাজার টাকা, চারটি টি-শার্ট ও চারটি ট্রাউজার তুলে দেন ইউএনও।
রবিউলের চিকিৎসার ব্যবস্থাকারী বোয়ালমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ঝোটন চন্দ বলেন, বিনামূল্যে রবিউলের সুচিকিৎসার জন্য পাবনা মানসিক হাসপাতালে ভর্তির যাবতীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেই তাকে পাঠানো হয়েছে। পাবনা মানসিক হাসপাতালের পরিচালকের সঙ্গে কথা বলে তার সকল ধরণের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করেছি। আশা করছি রবিউল ভাল হয়ে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে।
বোয়ালমারী থানার ওসি মোহাম্মদ নুরুল আলম জানান, রবিউলের খবরটি জানার পরপরেই পুলিশ সুপার মো. আলিমুজ্জামানের নির্দেশে তার বাড়ি ছুটে যাই এবং আমরা তাকে আর্থিক সহায়তা করি। প্রয়োজনে আরো সহায়তা করা হবে।
মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৪টায় মানসিক ভারসাম্যহীন রোগী মো. ওসমান ওরফে রবিউলের ভর্তির বিষয়টি নিশ্চিত করে পাবনা মানসিক হাসপাতালের পরিচালক আবুল বাশার মো. আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, বোয়ালমারী ইউএনও’র একটি দাপ্তরিক চিঠি পেয়ে রোগীকে ভর্তি করা হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবে ওই রোগীর চিকিৎসা শুরু হয়েছে। কিছুদিন পরে তার চিকিৎসার অগ্রগতি জানাতে পারবো।
ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার ময়না ইউনিয়নের বাসিন্দা মো, রবিউল মোল্লা (৩৫)। ১৫ বছর ধরে বাড়ির একটি ঘরে তার মাজায় শেকল পড়িয়ে আটকে রাখা হয়েছে। শিকল বন্দি হয়ে রবিউলের কাজ হয়েছে দুই হাত দিয়ে মাটি খোড়া। এই মাটি খুড়তে খুড়তে তার চারপাশের জায়গাটা একটি গোলাকার বাংকারেই রূপ নিয়েছে।
ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার ময়না ইউনিয়নের মধুমতী নদীর কাছে পশ্চিম চরবর্ণি গ্রামের। ওই গ্রামের বাসিন্দা দরিদ্র রিক্সা ভ্যান চালক মো. নুরুল মোল্লা (৫৮) ও আসমানি বেগম দম্পতির তিনটি ছেলের বাবা-মা। এর মধ্যে রবিউল সকলের বড়। মেঝ ছেলের নাম ইমরান মোল্লা (৩১) ও ছোট ছেলের নাম এনামুল মোল্লা (২৩)।
রবিউলের মা আসমানী বেগম জানান, দুরন্তপনায় জুড়ি মেলা ভার ছিল রবিউলের। খেলাধুলা করা, নদীতে সাঁতার কাটা, বাইসাইকেল চালানোয় তার সমকক্ষ ছিল না গ্রামের অন্য কেউ। কিন্তু নয় বছর বয়সে এক জ্বর রবিউলের জীবনের সর্বনাশ ডেকে আনে। তছনছ করে দেয় পুরো পরিবারটিকেই।
রবিউলের বয়স যখন নয় বছর, তখন জ্বর হয় তাঁর। আস্তে আস্তে হাত-পা শুকিয়ে যেতে থাকে। মুখের কথা হারিয়ে যায়। সাধ্যমতো কবিরাজ ও ডাক্তার সব দেখানো হলেও আর সুস্থ্য স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেনি রবিউল। রবিউলের ১৬/১৭ বয়স থেকেই চ‚ড়ান্তভাবে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন তিনি।
এক পর্যায়ে তার আচরণ হয়ে পড়ে উন্মাদের মত। মারধর করা, জিনিস পত্র ভাঙচুর করা যেন তার নেশা হয়ে ওঠে। অবশেষে বাধ্য হয়ে তাকে শেকল দিয়ে আটকে রাখা হয়। এভাবে কেটে গেছে ১৫টি বছর।
এ খবরটি বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত হলে নড়েচড়ে বসে পুলিশ ও প্রশাসন। এরই ধারাবাহিকতায় রবিউলকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করা হয়।